Amartya sen Interview

ভারতের ধারণাকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, মত অমর্ত্য সেনের

জাতীয়

মোদী সরকারের সাম্প্রদায়িক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী নীতিতে ভারতের ধারণা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। বললেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। মোদী সরকারের সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি আচরণকে তিনি ‘অগ্রহণযোগ্যভাবে বর্বরোচিত’ বলেছেন। ‘দ্য ওয়ার’-এ বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন নিজের আগের অবস্থানে অনড় থেকে জানিয়েছেন, মোদী সরকার দুনিয়ার সবথেকে ভয়ঙ্কর সরকার। এদিনই সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিজেপি সংখ্যালঘুদের গুরুত্বহীন করে দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদীদের ভূমিকাকে বৃদ্ধি করতে চাইছে। 
অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের দৃষ্টিকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে বিজেপি। ভারতের ধারণাকে সঙ্কুচিত করে তাকে শুধুমাত্র হিন্দু ভারত এবং হিন্দি বলা ভারতে পরিণত করছে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হবে যদি দেশে বিজেপি বিরোধী কোনও বিকল্প না থাকে। এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেন, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট বিজেপি একতরফাভাবে জিতে নেবে বলে মনে করা ভুল হবে। এ ক্ষেত্রে আগামী লোকসভা ভোটে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলেই তাঁর অভিমত। 
কিছুদিন আগে ফরাসি সংবাদপত্র ‘লে মদেঁ’ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, দুনিয়ায় সবথেকে ভয়ঙ্কর সরকার হলো মোদী সরকার। এদিনের সাক্ষাৎকারে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন। অমর্ত্য সেন বলেন, মোদী সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে কদর্য আচরণ করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতার বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি তুলে ধরেন কীভাবে কোভিড মহামারীর সময়ে সরকারের নীতিতে মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে। কাজ, খাবার না থাকা, পরিযায়ী শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফেরার প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেন। গরিবের দুর্দশাকে যেভাবে সরকার উপেক্ষা করেছে সেটাকেই তিনি প্রকৃত যন্ত্রণা বলে উল্লেখ করেছেন।  
অমর্ত্য সেন বলেন, ভারত সব সময়ে বহু জনগোষ্ঠীর দেশ। ভারত যে একটি মিশ্র সংস্কৃতির দেশ, বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তা তুলে ধরে অমর্ত্য সেন বলেন, সেই জায়গায় একতরফাভাবে একমাত্র হিন্দুদের ভারতীয় বলে বিবেচনা করা, অন্য কারোকে ভারতীয় বলে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করা ভয়ানক বিষয়। যা এই দেশের চরিত্র সম্পর্কে আশঙ্কাজনক বিভ্রান্তি তৈরি করছে। ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকে অস্বীকার করা চূড়ান্ত মুর্খামি। মোদী সরকারের সাম্প্রদায়িক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী নীতিতে ভারতের ধারণা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে তিনি যে গভীর উদ্বিগ্ন, সেকথাও জানান ৯০ বছর প্রবীণ অর্থনীতিবিদ। 
অমিত শাহ সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা, বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা মুসলিমদের কখনও উইপোকা, কখনও বাবরের বাচ্চা বলে উল্লেখ করছে, কেউ কেউ মুসলিমদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলছে, এই প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, ভারত সম্পর্কে তাদের যে ধারণা তার প্রতিফলন এইসব ভাষা। ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণা বিকৃত বলে মন্তব্য করেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি আরও বলেন, মোদী সরকার নেশন কী সেটাই বোঝে না। ভারতে বিভিন্ন সংস্কৃতি রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে একমাত্র হিন্দুদের ভারতীয় বলা হচ্ছে, আরেকটি অংশকে প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে বলা হচ্ছে। এইসব করে দেশের চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। 
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কি মনে করেন যে দেশে মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, আমি এই ঘটনায় শুধু উদ্বিগ্ন নই, আমি আতঙ্কিত যে, বিবিধ উপাদানে তৈরি একটি দেশকে সর্বনাশা বিচ্ছিন্নতায় নিয়ে যাওয়া হলো। সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার রাষ্ট্রের অন্যতম একটি বৃহৎ মুর্খামি বলে উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেছেন, মুসলিমদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে দেশের ইতিহাস এবং বর্তমানকে চূড়ান্তভাবে  কলঙ্কিত এবং ধ্বংস করা হচ্ছে। 
এদিনই সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বিজেপি সিএএ কার্যকরী করতে চাইছে কারণ তারা চাইছে সংখ্যালঘুদের গুরুত্বহীন করে দিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ, সমানাধিকারী দেশের ক্ষেত্রে এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। সব ভারতীয়ের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে এবং তারা নিজেদের ভারতের নাগরিক মনে করবে এইরকম পরিবেশ থাকা প্রয়োজন। অন্তত গান্ধীজী তাই করতে চেয়েছিলেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। গান্ধীজী ধর্মচর্চায় গভীরভাবে হিন্দু ছিলেন, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে মুসলিমদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। সংখ্যালঘুদের অবজ্ঞা করার জন্য ভারতকে একদিন অনুশোচনা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ। 
আগামী লোকসভা ভোট সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে পিটিআই-কে তিনি বলেছেন, বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলে তিনি মনে করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসের নাম বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, কিন্তু আমি জানি না, এই মুহূর্তে তাদের কী অবস্থা। মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এই প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন বলেছেন, তাঁর সেই ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু, এটা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি যে, মমতা বিজেপি’র বিরুদ্ধে জনগণের হতাশার জায়গাগুলোকে একত্র করে দেশে বিভেদের রাজনীতির অবসান ঘটাতে নেতৃত্ব দেবেন। কংগ্রেস প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন, কংগ্রেস খুবই দুর্বল হয়েছে মনে হচ্ছে। আমি জানি না এই অবস্থায় কেউ কংগ্রেসের উপর কতটা নির্ভর করতে পারবে। অন্য দিকে, কংগ্রেসই একমাত্র দল যাদের একটা সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু আবারও বলছি, কংগ্রেসের মধ্যেই বিভাজন আছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment