প্রতীম দে
সন্তান হারা মা তখনও একটা কথা বলে যাচ্ছেন, ‘‘আমার ছেলে কোথায়?’’
‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ সংখ্যা। পুষ্প দেবীর সেই আর্তনাদ শিরোনাম হয়েছিল।
১৯৫৯ সাল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকারের খাদ্য নীতির কারণে রাজ্য জুড়ে সঙ্কট। দাম বাড়ছে খাদ্যের। কলকাতার রাস্তায় গ্রামের মানুষ বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন, সবার আর্ত- ‘একটু ফ্যান দাও’। শীর্ণকায় শরীরগুলো আরও শীর্নকায় হচ্ছে। ভূমি সংস্কার হয়নি তখনও। ফসলের বড় অংশই জমা ছিল আড়তদার, মজুতদার, মুনাফাখোরদের কাছে। রেশন ব্যবস্থা নেই। মানুষ খাদ্য শস্য পাচ্ছেন না।
ওই বছর ১০ জুনের ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘‘সরকারের খাদ্যনীতিতে এবং খাদ্যনীতি পরিচালনা ব্যবস্থায় আত্মঘাতী ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য পশ্চিমবাংলা রাজ্যে আবার একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের পটভূমিকা তৈরি হচ্ছে। ভিক্ষার আশায় কলকাতার পথে পথে নিরন্ন চাষী ও ভূমিহীন দিন মজুরেরা ইহারই সুস্পষ্ট লক্ষণ। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের প্রাক্কালেও এরকম দৃশ্য দেখা গিয়েছিল।’’
এ বছর ১৯৪৩-এ ব্রিটিশ জমানায় দুর্ভিক্ষের আশি বছরও। ১৯৫৯’র খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করার সময় তার ঠিক ষোল বছর আগের দুর্ভিক্ষও নজরে থাকছে আমাদের। উৎপাদন নয়, মানুষের হাতে খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার দরুণ তীব্র অপুষ্টির ছবি আজকের ভারতেও।
১৯৫৯ সালেই আনন্দবাজার পত্রিকা একটি খবর প্রকাশ করে। যেখানে লেখা হয়, ‘‘অনাহারে এখনও পর্যন্ত ৮০ জনের মৃত্যু হইয়াছে।’’
যদিও সে সময়ে খাদ্যমন্ত্রী, পরবর্তীকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রফুল্ল সেন মন্তব্য করেছিলেন, ‘সব ঝুট হ্যায়’।
না। সেইদিন এই সব খবর মিথ্যা ছিল না।
খাদ্য সঙ্কটের সময় বামপন্থী রাজনৈতিক দল গুলি মিলিত ভাবে একটি মঞ্চ গঠন করে। যার নাম ছিল ‘দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। সেই কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের সামনে ৯ দফা দাবি রাখা হয়।
১. সংশোধিত রেশনিং মারফত রাজ্যবাসীর সর্বস্তরের জনসাধারণকে সাড়ে সতেরো টাকা মন দরে চাল সরবরাহ করতে হবে (এক মন মানে প্রায় ৩৭ কেজি)।
২. খুচরো দোকান মারফত খোলা বাজারে নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত মূল্যে চাল সরবরাহ করতে হবে।
৩. সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে চালু করতে হবে।
৪. চাল কলগুলির উপর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ লেভি বসাতে হবে।
৫. পাঁচ লক্ষ টন খাদ্য মজুত করতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. ব্যাপকভাবে মাথাপিছু দৈনিক দেড়টাকা হারে সপ্তাহব্যাপী টেস্ট রিলিফ চালু করতে হবে।
৮. দুঃস্থ ব্যক্তিদের খয়রাতি সাহায্য দিতে হবে।
৯. সর্বস্তরে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে হবে।
খাদ্যের দাবিতে কলকাতার ময়দানে সমাবেশ করেছিলেন গ্রাম থেকে আসা জনতা। শান্তিপূর্ণ ভাবে তাঁরা মিছিল করেছিলেন খাদ্যের দাবিতে। সেই মিছিলকেই চারদিক থেকে ঘিরে বিনা প্ররোচনায় লাঠি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় ৮০ জনের। ১০০ জন আজও নিখোঁজ।
সেদিনের ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় পুষ্প দেবীর বক্তব্য প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে? ঐ যে পুলিশ আমাকে মারলো, ছেলেটা বুক থেকে পড়ে গেলো রাস্তায়।’’
দমদমের দিকে শাক-সব্জি বিক্রি করতেন পুষ্প, কখনও একমুঠো জুটতো, কোনদিন বা জুটতো না।তাই ৩১ আগস্ট ১৯৫৯ সালের মিছিল ছোট সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন। পুলিশের লাঠি পড়েছিল পুষ্প দেবীর পিঠে। হাতেও পড়েছিল লাঠি। ছেলে কোল থেকে পড়ে যায়। তারপর আর সেই ছেলেকে তিনি পাননি।
১৯৫৯ থেকে ২০২৩। ৬৪টি বছর পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু খাদ্যের দাবিতে মানুষের সংগ্রাম, লড়াই কোন ভাবেই কমে যায়নি।
ঠিক এখন কী অবস্থা? কেন্দ্রের বিজেপি সরকারেরই তথ্য, আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এবার খাদ্যদ্রব্যের দাম ৭.৭৫ শতাংশ বেড়েছে। এ বছরেরই জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ৭.১৩ শতাংশ বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। সবজির দাম বৃদ্ধির হার ৬২.১২ শতাংশ।
২০২১ সালের ১৪ আগস্ট ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় একটি খবর। স্বাধীনতার দিবসের আগের দিন। অভাবের তাড়নায় সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করার ঘটনা স্বীকার করেন মেদিনীপুর শহরের আবাস ইন্দকুরি এলাকার বুধনি ভুঁইয়া নামে এক মহিলা। তিন দিন কারো পেটে ভাত জোটেনি। খিদেয় চিৎকার করতেও ভুলে গেছে যেন তিন সন্তান।
সময় বদলেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি বদলেছে, কিন্তু আজও বাংলার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি।
গ্রাফিক্স: মনীষ দেব
Comments :0