বছর বছর নানা কেন্দ্রীয় সরকারি স্কলারশিপের বরাদ্দ কমছে। বেশ কয়েকটি স্কলারশিপ বাতিল করার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি অনুদান কমিয়ে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ভাতা ও মেরিট-কাম-মিন্স স্কলারশিপের অর্থ বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। গত সপ্তাহেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। প্রান্তিক অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘ন্যাশনাল ওভারসিজ স্কলারশিপ’ (এনওএস) দেয়, তা এই বছর নির্ধারিত ১০৬ জনের বদলে মোটে ৪০ জনকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রককে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অধীনে থাকা মন্ত্রীসভার অর্থনীতি বিষয়ক কমিটি টাকা ধার্য করতে চাইছে না। একদিকে স্কলারশিপ বরাদ্দে এমন হ্রাস, অন্যদিকে কয়েক বছরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়েছে মোদীর ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-এ সরকারি ব্যয়। তবে এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী, তাই কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে বলে উঠতে পারেনি। ইতিমধ্যে শনিবার এই বিষয়ে কটাক্ষ করেছেন কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে।
গত ২০১৮ সালে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ শুরু করা হয়। প্রথম বছর তার বরাদ্দ ছিল ৩.৬৭ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে তার বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮.৮২ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সাত বছরে ব্যয় বরাদ্দ অন্তত ৫২২ শতাংশ হারে বেড়েছে। এদিকে এই ‘চর্চা’-এ ঠিক কী হয়, তার উদ্দেশ্যই বা কী, তা কেন্দ্রের শিক্ষা মন্ত্রক এখনও পর্যন্ত সঠিক ভাবে বলে বোঝাতে পারেনি। গত বছর দুয়েক ধরে এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোদীর ছবি দিয়ে ১১১১টি সেলফি পয়েন্ট তৈরি করা হয়। তাতে মোট ২.৪৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সরকারি তথ্য সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে সেলফি পয়েন্টের সঙ্গে শিক্ষা, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা পরীক্ষার কী সম্পর্ক রয়েছে তা সরকারের কোন প্রতিনিধিই বুঝিয়ে উঠতে পারেননি।
দেশে পরীক্ষা ও পঠনপাঠন সংক্রান্ত যে সমস্ত বুনিয়াদি সমস্যা রয়েছে, যেমন শিক্ষান্তে কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধি, পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা বন্ধ করা এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো, ইত্যাদি নিয়ে এই প্রকল্প কিংবা তাঁর মুখ্য ‘পোস্টার বয়’ নরেন্দ্র মোদীর কোন মাথাব্যথা নেই। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলো নানা সময় মোদীর ছবি, ভিডিও বা সোশাল মিডিয়া পোস্টের প্রচার করা। পাশাপাশি নানা রকম কথোপকথন বা ‘মন কি বাত’-র ধাঁচে স্বগতোক্তির আয়োজন করা। তার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে মোদীর মানবাকৃতি হোর্ডিংয়ের সামনে সেলফি তোলার বন্দোবস্ত করা। এগুলি শুনতে হাস্যকর হলেও, এর পিছনে শিক্ষার মোট বরাদ্দের এক বড় অংশ ব্যয় করা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা এই প্রকল্পকে ‘এক দিনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচী’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তবে বলা বাহুল্য এতেই গত ২০২৪-এ ৬.৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
কোভিডের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদীকে মধ্যমণি রেখে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-র অনুষ্ঠান অনলাইনে আয়োজন করা হয়। তবে এই অনলাইন অনুষ্ঠানেও সরকারি হিসাবে অন্তত ৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এই আকাশছোঁয়া বিলে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়েছে। ঠিক কোন খাতে এই প্রকল্পের টাকা যাচ্ছে? তা নিয়ে অবশ্য সরকারি নথিতে কিছু জানা যায়নি। এটিও তার মোট ব্যয়ের সামান্য অংশ। সর্বসাকুল্যে আরও বেশ কয়েক কোটি টাকা এই প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত গত এক বছরে অন্তত পাঁচটি কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষা স্বচ্ছতার প্রশ্নে বাতিল করতে হয়েছে। গত বছর নিট-ইউজি’র প্রশ্নফাঁস ও দুর্নীতির ঘটনার পর একে একে নিট-পিজি, নিট-এসএস, ইউজিসি-নেট, সিএসআইআর-নেট সহ বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষা স্বচ্ছতার অভাব কিংবা আগাম প্রশ্নফাঁসের
অভিযোগে বাতিল করতে হয়। এবছরও মোটে ১২ দিন আগে নিট-পিজি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অবশ্য এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-র কোন বক্তব্য নেই। মোদীর পর্চারেই তা মেতে রয়েছে।
একদিকে যখন এই ধরনের প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ছে, ঠিক একই সময় স্কুলশিক্ষা, গণশিক্ষা প্রসার ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা প্রকল্পের উপর ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় মেরিট কাম মিন্স স্কলারশিপ প্রকল্প ও উদ্ভাবনী শিক্ষা কর্মসূচির মতো নানা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। তার জায়গায় শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়ছে বেসরকারি কর্পোরেট সিএসআর পুষ্ট অনুদানের দাপাদাপি। গত ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৫-২৬-র অর্থবর্ষে এই খাতে কেন্দ্রীয় বাজেটের বরাদ্দ ২৩.২ শতাংশ হারে কমানো হয়েছে। গত ২০২১ থেকে কেন্দ্রের শিক্ষা দপ্তরের নেওয়া ‘ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চ এগজামিনেশন’ স্থগিত রাখা হয়েছে। তার ফলে প্রায় দু হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রান্তিক অংশ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ ভাবে আক্রমণের শিকার। ২০২৪-র ডিসেম্বর মাস থেকে সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাপ্য মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল স্কলারশিপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহেই দলিত, আদিবাসী, ভূমিহীন কৃষক, খেতমজুর সহ সমাজের একেবারে প্রান্তিক অংশের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এনওএস স্কলারশিপও আংশিক ভাবে বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। প্রথমে মেধা তালিকায় এই স্কলারশিপের জন্য ১০৬ জনকে ‘যোগ্য’ বলে ঘোষণা করা হয়। তারপর ১ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলা হয়, এর মধ্যে মোটে ৪০ জনের জন্য ‘অ্যাওয়ার্ড লেটার’ মারফত অর্থ বরাদ্দের ঘোষণাপত্র পাঠানো হবে। তাঁদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় স্কলারশিপ নিতে অস্বীকার করলে বাকি ৬৬ জনের মধ্যে কাউকে তা দেওয়া যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্য ভাবে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-র মতো কেন্দ্রের নানা প্রসাধনী প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে রবিবার প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। গণশক্তিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, ‘‘দেশে হীরক রাজার রাজত্ব চলছে! মোদী আত্মপ্রচারের মতো অহেতুক বিষয়ে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। অন্য দিকে শিক্ষার নানা গুরুতর ক্ষেত্রে ব্যয় কমানো হচ্ছে, নানা স্কলারশিপ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আসলে প্রান্তিক অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া করার সুযোগ, স্বাধীন ভাবে ভাবনা চিন্তা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।’’
শনিবার এই বিষয়ে ‘এক্স’-এ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। সম্প্রতি এক সরকারি রিপোর্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে স্কুল শিক্ষার মান বর্তমানে প্রাক-কোভিডের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। প্রাথমিক স্কুলে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের ৪০ শতাংশের অক্ষরজ্ঞান নেই, ৫০ শতাংশ একেবারে সহজ অঙ্কও পারে না, ৬২ শতাংশের ঋতুজ্ঞান নেই, ৪৪ শতাংশ সহজ বাক্যও পড়তে পারে না। মাধ্যমিক স্তরের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই প্রসঙ্গে এদিন ‘এক্স’-এ খাড়গে বলেন, ‘‘পরীক্ষা পে চর্চা বা একজাম ওয়ারিয়র্স’র মতো প্রকল্প দিয়ে শিক্ষার প্রকৃত পরিস্থিতির অবস্থা চুনকাম করা যাবে না। শিক্ষার প্রতি মোদী সরকারের টানা অবহেলায় দেশের ভবিষ্যৎ আজ সঙ্কটের মুখোমুখি।’’
Parikhsha Pe Charcha
কোটি কোটি টাকার সেলফি স্ট্যান্ড বানিয়ে চলছে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’

×
Comments :0