বীরভূমের দেউচায় হাজার হাজার আদিবাসী পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের রুজিরোজগার-অন্নসংস্থান বন্ধ করে অতিকায় কয়লাখনি প্রকল্পের রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে নিজের শিল্পমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী ভাবমূর্তি গড়ে তোলার যে চেষ্টা মমতা ব্যানার্জি বেপরোয়াভাবে করে চলেছেন আদতে সেটা ভাঁওতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রকল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে চুক্তি ভঙ্গ, বিশ্বাস ভঙ্গ আর অস্বচ্ছতার কাহিনি। বলা যায় মমতা ব্যানার্জির সাধের এই প্রকল্প এক বড় মাপের দুর্নীতি কেলেঙ্কারির চলন্ত ও জীবন্ত উদাহরণ।
দেশের কয়লা সম্পদ বেসরকারি কর্পোরেটের লুটের জন্য তুলে দেবার কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ব্যতিক্রম হিসাবে ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিয়ম দেউচা কয়লা ব্লক পায়। লক্ষ্য রাজ্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির জন্য নিজস্ব কয়লার জোগান নিশ্চিত করা। কিন্তু গোড়া থেকেই এই কয়লা ব্লকের মজুত ভাণ্ডার এবং তা উত্তোলন নিয়ে নানা সন্দেহ ও বিতর্ক দানা বাঁধে। প্রথমত, কয়লা মজুতের মোট পরিমাণ, দ্বিতীয়ত, কয়লার গুণমান, তৃতীয়ত, ভূপৃষ্ঠ থেকে গভীরতা এবং কয়লার উপরে কঠিন পাথরে স্তর। অর্থাৎ এহেন কয়লা ব্লক থেকে কয়লা তোলা আদৌ লাভজনক হবে কিনা, নাকি খাজনা থেকে বাজনা বেশি হবে সন্দেহ দানা বাঁধে সেখানেই।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের বার্ষিক শিল্প ধামাকায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন দেউচা প্রকল্পে এক লক্ষ মানুষের চাকরির পাশাপাশি আগামী একশো বছরের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজনীয় কয়লার জোগান নিশ্চিত হবে। কিন্তু দিন যত এগচ্ছে ততোই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। এটা আদৌ একটি কয়লা প্রকল্প না ব্যাসাল্ট প্রকল্প তা নিয়ে ধন্দ দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের জন্য যে বেসরকারি সংস্থা বরাত পেয়েছে তারা কয়লার বদলে ব্যাসাল্ট উত্তোলনের কাজে নেমেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি রাজ্য সরকারি সংস্থা। তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লার জোগান নিশ্চিত করতে নিজস্ব কয়লাখনি তারা নিতেই পারে। কিন্তু কয়লার বদলে ব্যাসাল্ট খনিতে তাদের উৎসাহে দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
কয়লা ব্লক পাবার শর্ত অনুযায়ী নিগমকে জিওলজিক্যাল রিপোর্ট এবং মাইনিং প্ল্যান জমা দিতে হয়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে নিগম তা করেনি। তেমনি প্রকল্প শুরুর আগে ৪৩১ একর কয়লা ব্লকের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন করা হয়নি, হয়েছে মাত্র ১২ একরের জন্য। আইন অনুযায়ী ৫০ একরের বেশি এলাকার প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে হলে জনশুনানি এবং কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে পরিবেশ প্রভাব সমীক্ষা করাতে হয়। সেটা এড়াতে ১২ একরের জন্য সহজ ছাড়পত্র নিয়ে বিধিলঙ্ঘন করা হয়েছে দুনীর্তির রাস্তা খোলা রাখার জন্য।
টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম ও ট্রান্সমেরিন অ্যান্ড কনফ্রেইট লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড নামক এক সংস্থাকে বরাত দেয় একাজে তাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বা এমন কোনো ব্যবসার সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। তাই দুর্নীতির গন্ধ এখানেও। কিছুদিন পর চুপিসারে হিমাদ্রি স্পেশালিটি কেমিক্যালস নামে একটি সংস্থা বরাত পাওয়া ট্রান্সমেরিনকে সাড়ে চার কোটি টাকায় কিনে নেয়। এই দুই সংস্থার আড়ালে কারা কাঠি নাড়ছে, এরা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিনা বলা মুশকিল। তবে বরাতের শর্ত ভঙ্গ করে সংস্থার মালিকানা বদল হয়েছে। ৪-৫ কোটি টাকার একটা সংস্থা ৫০০০ কোটি টাকার ব্যাসাল্ট তোলা ও বিক্রির বরাত পেয়েছে। বরাত পেয়ে অন্য মালিকের অধীন হয়েছে। বরাত পাওয়ার পর কোনও সংস্থার মালিকানা বদল করা যায় না। করলে বরাত বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে দেউচা ঘিরে বড়সড় আর্থিক কেলেঙ্কারি আয়োজন হয়েছে আঁটঘাট বেঁধে। নাটের গুরু সরকার। কোনোটাই অজানা নয় মুখ্যমন্ত্রীর। তাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত জরুরি। ধরতে হবে, খুঁজে বার করতে হবে কুশীলবদের।
Deucha Panchami
দেউচা কেলেঙ্কারি

×
Comments :0