Adeno virus

আতঙ্কিত না হয়েই অ্যাডিনো ভাইরাসকে রুখুন

রাজ্য

অ্যাডিনো ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করে উপশম মেলে। দুই বছর পর্যন্ত শিশুদের এর প্রকোপটা বেশি দেখা যায়। তবু ০-২বছরের শিশুদের ৯৫ শতাংশের সামান্য ওষুধেই রোগ মুক্তি ঘটে। আর যাঁদের বয়স পাঁচের বেশি তাঁদের কোনও দুরারোগ্য ব্যধি না থাকলে তা নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। অভিভাবকদের তাই অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশিষ্ট শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরুণ সিং। ভারতে ২০২২ সালে করোনার ইতি হতে চলেছে বলে তিনিই প্রথম মন্তব্য করেছিলেন।
ডাঃ অরুণ সিং জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়টা জাগছে তার কারণ কোভিডেও শিশুরা মোটামুটি সুরক্ষিত ছিল। তাহলে অ্যাডিনো ভাইরাস এমন কী শক্তিশালী যা বড়দের ছেড়ে শিশুদের আক্রান্ত করে চলেছে ? শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিং-এর মতে, আতঙ্কের জেরেই এখন শিশুদের চিকিৎসা নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। শিশুরা অ্যাডিনো ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের বাড়িতে রেখেই সুস্থ করে তোলা যায়। যেকোনও আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। এটা প্রতিবছর ঘটে। 
শীত চলে যাওয়ার সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত হয়। এবারে প্রকোপ হেনেছে অ্যাডিনো ভাইরাস। ২ বছর পর্যন্ত শিশুদের এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতের অন্যত্রও এবছর অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তাই সর্দি-জ্বর-কাশি’র মতো উপসর্গ হলেই  ‌আতঙ্কিত হয়ে শিশুকে হাসপাতালে না ছোটার পরামর্শ দিয়েছেন ডাঃ অরুণ সিং। অসুস্থ শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলে সেখানে ঠিকমতো বেড মিলবে না, শুশ্রুষা তো পরের কথা। তাই বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করেই শিশুকে সুস্থ করা ঢের ভালো। ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশু সুস্থ হয়ে যায়। 
অ্যাডিনো ভাইরাসের যে বিষয়টি সকলের মনে ভয় তৈরি করে তা হলো জ্বরের প্রাবল্য। ১০৩-১০৪ পর্যন্ত শিশুদের জ্বর হতে দেখা যায়। তার ওপর আরও ভয় ধরে যখন দেখা যায় জ্বর থেকে যায় দীর্ঘদিন। ৭-১০ দিন, এমনকি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত জ্বর থাকতে পারে। আর এতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন অভিভাবক থেকে অনেক চিকিৎসক। দিয়ে ফেলেন  অ্যান্টিবায়োটিক। আর তাতেই আরও হিতে বিপরীত হয়। বাড়তি ওষুধ শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। হাসপাতালে গেলে অতিরিক্ত ওষুধের ভার শিশু নিতে পারে না। 
তাহলে সর্দি-কাশি-জ্বর হলে কী করতে হবে ? শিশুকে একাধিকবার স্নান করাতে হবে। গরম জলের ভাপ এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে। সেই জন্য ইলেকট্রিক কেটলির মুখ খুলে ঘরের মধ্যে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যাদের ইলেকট্রিক কেটলি নেই তাঁরা প্রেসার কুকারে সিটি খুলে সেই বাষ্প শিশু যেখানে রয়েছে তার একটু দূরে রাখতে পারেন। শিশু স্বাভাবিকভাবে সেই ভাপ টেনে নিতে পারবে। আর জ্বরকে ঠেকাতে সেই একই ওষুধ প্যারাসিটামল। ৪-৬ঘণ্টা অন্তর প্যারাসিটামল দেওয়া দরকার। জ্বর আছে কী নেই, জ্বর কখন আসবে তার  অপেক্ষা না করেই ওই সময় অন্তর প্যারাসিটামল সিরাপ বা ট্যাবলেট দিতে হবে। বেশি বেশি করে স্নান, জল,  বুকে দুধ খাওয়াতে হবে শিশুকে। নাক বন্ধ হয়ে গেলে নাকে ড্রপ আর কাশি বেশি হলে অ্যাসথালিন সিরাপের মতো ব্রঙ্কোডায়লেটর দেওয়াটা জরুরি। এতে কফ উঠতে থাকবে। আর এরপরেও শ্বাস নিতে ‘সো সো’ শব্দ হলে অনেক সময় স্টেরয়েড দিতে হয়। 
অনেকের ক্ষেত্রে ভাইরাস জ্বরে বমি-পায়খানা হতে পারে। সেই অনুযায়ী ওষুধ দিতে হয়। দীর্ঘ দিন জ্বরে ভুগলে চোখ লাল হয়। সেক্ষেত্রে ওষুধ দিতে হয়। এসবটাই  চিকিৎসকরা জানেন। তাই জ্বরের সঙ্গে কাশির প্রকোপ বাড়লে সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা ভালো। যাঁরা মায়ের দুধ খায়, তাঁদের কথা ভিন্ন। অন্যদের এই সময় গলাভাত, খিচুড়ি আর পাকা কলা (কাঠালি) খাওয়ানোটা দরকার। মাছও চলে পারে। তবে অসুস্থ শরীরে বাচ্চাদের বাইরের দুধ কিংবা মিষ্টি না খাওয়ানোটাই ভালো। 
অ্যাডিনো ভাইরাস আক্রান্ত হলে বাচ্চাদের একটু আলাদা রাখাটা দরকার। শ্বাসকষ্ট বাড়লে তখন বাচ্চাকে সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট দিতে হয়। প্রথমে অক্সিজেন, তাতেও সমস্যা হলে ভেন্ট্রিলেশনে রাখতে হয়। এই সময় অনেকের ডায়েরিয়া দেখা দিলে স্যালাইন পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। তবে আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ এই জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাঁরাও সহযোগী শুশ্রুষায় সেরে ওঠে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সময় বেশি হলেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়।
এদিকে, অ্যাডিনো ভাইরাসের সঙ্গে সঙ্গে কাওসাকির ভাইরাসের প্রকোপও জেলায় জেলায় দেখা যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশিষ্ট কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী। তিনি জানাচ্ছেন, এখন পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে যে ভাইরাস জ্বর দেখা যাচ্ছে তার এক তৃতীয়াংশ অ্যাডিনো ভাইরাস। বাকি দুই তৃতীয়াংশ কী ধরণের ভাইরাস তা এখনো জানা যাচ্ছে না। সরকারের কাছে এবিষয়ে কোনও তথ্য নেই। পরীক্ষাও চলছে না। সরকারি পরিকাঠামোর একেই অপ্রতুল, তার ওপর একের পর এক জারি হচ্ছে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা। 
বলা হচ্ছে, অসুস্থ শিশুকে অন্যত্র রেফার করা যাবে না। অত্যাধিক শ্বাসকষ্টের শিশুকে ভেন্ট্রিলেটরে রাখার দরকার হলে কী করবেন সেই সব হাসপাতালের চিকিৎসকরা ! স্বাস্থ্য দপ্তর  প্রাপ্ত বয়স্কদের ভেন্ট্রিলেটর যন্ত্রের পাইপের ব্যাস কমিয়ে তা ব্যবহারের কথা বলছে। পাঠানো হচ্ছে না কোন যন্ত্র বিশেষজ্ঞকে। তাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সে কাজ করতে চাইছেন না অনেক সরকারি চিকিৎসক। এর পাশাপাশি ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ শনাক্ত করতে ‘রেসপিরিটরি ভাইরাল প্যানেল টেস্ট’ ঠিকমতো করা হচ্ছে না। আর এই না করার জন্যই চিকিৎসা করতে সমস্যা হচ্ছে। অধিকাংশ ভাইরাসই  অপরিচিতি হয়েই থেকে যাচ্ছে। 
কলকাতায় নাইসেড এবং স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এই ভাইরাস টেস্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে পিসিআর মেশিন রয়েছে, সেখানেই এই পরীক্ষা সম্ভব। কোভিডের সময় থেকে অনেক জেলা হাসপাতালেই পিসিআর মেশিন রয়েছে। সরকারকে শুধু ভাইরাল প্যানেল টেস্ট  কিট সরবরাহ করলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। অথচ সে সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। কেবল বারে বারে অসুস্থ শিশুকে হাসপাতালে ছুটিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এতে কিন্তু হীতে  বিপরীত হয়ে চলেছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment