বাকিবুর রহমান মাথা নয়। তবে রেশন দুর্নীতির চক্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। করোনা কালে অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২২’ র মধ্যেই এই দুর্নীতির কারবার বেশি ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। প্রাথমিক ভাবে দেখা গেছে বাকিবুরকে কেন্দ্র করেই এই রেশন দুর্নীতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। বাকিবুরের রাইস মিলে মিলেছে খাদ্য দপ্তরের ১০০টির বেশির স্ট্যাম্প।
ধৃত বাকিবুরের একাধিক শিখণ্ডী সংস্থা। তার মধ্যে ছটির নির্দিষ্ট হদিশ, নথি হাতে এসেছে ইডি’র। সেখানেই খাদ্য সাথী প্রকল্পে রেশনের মাধ্যমে আটা বণ্টন দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে। যেমন- এনপিজি রাইসমিল প্রাইভেট লিমিটেড, রুদ্রাক্ষ ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেডে, ত্রিমূর্তি ইনফ্রা ডেভলপার্স প্রাইভেট,কানাইয়া নির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেডের মত সংস্থা। সবকটির মালিক ধৃত বাকিবুর রহমান। রেশন দুর্নীতির ৫০কোটি ৫৫ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা ঢুকেছে বাকিবুরের এরকম ৬টি সংস্থায়।
দু’দিনের হেপাজতের মেয়াদ শেষে এদিন আদালতে তোলা রেশন দুর্নীতি চক্রের অন্যতম পান্ডা এই বাকিবুর রহমান। আদালতে ফের তাকে নিজেদের হেপাজতে চেয়ে ইডি সওয়ালে এরকম একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য সামনে আনে। তিন বছর আগে রাজ্য পুলিশ রেশন দুর্নীতি নিয়ে এফআইআর রুজু করলেও মামলা এগয়নি। প্রভাবশালী মাথাকে বাঁচাতেই তদন্ত হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সোমবার নগর দায়রা আদালতে ইডি’র তরফে আইনজীবী বিচারকের সামনে বলেন- ধৃত বাকিবুর রহমানের রাইস মিল থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রায় ১০৯টি স্ট্যাম্প। এর মধ্যে রয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল এসেনশিয়াল কমোডিটিজ সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেড, খাদ্য সরবরাহ দপ্তরের চিফ ইন্সপেক্টর, সাব ইন্সপেক্টর ও পারচেজ অফিসারের স্ট্যাম্পও রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে।
খাদ্য সাথী প্রকল্পে কোটার থেকে কম পরিমাণে আটা রেশনে সরবরাহ করা হত। মিল মালিক ও ডিলারের সঙ্গে যোগসাজশে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সামগ্রী কম সরবরাহ করা হত। তা খোলা বাজারে বিক্রী করা হত। বিপুল টাকার কারবার। সরাসরি খাদ্য দপ্তরের একাংশের যোগের তথ্যও সামনে এসেছে বলে দাবি ইডি। এদিন আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে জানানো হয়- ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নদিয়ার কোতোয়ালি থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়। সেই এফআইআর’কে ভিত্তি করেই ইডি ২০২২ সালে ইসিআর রুজু করে যা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে এফআইআর’র শামিল। তার ভিত্তিতেই শুরু হয় তদন্ত। নিয়োগ দুর্নীতি থেকে পৌর দুর্নীতির মাঝেই সেই তদন্ত বেশ কয়েকজনকে জেরা করে সামনে আসে বাকিবুরের রাইস মিলের প্রসঙ্গ। ২০২০, ২০১২ ও ২০২২- পরপর তিন বছর নদীয়ার তিনটি থানা কোতয়ালি, ধুবুলিয়া ও নবদ্বীপে এফআইআর রুজু হয় এই রেশনের সামগ্রী বণ্টন দুর্নীতি নিয়ে।
নদীয়ায় সেই রাইসমিলে তল্লাশি অভিযানের পরেই বাকিবুরের কৈখালির আবাসনে হানা দেয় ইডি। টানা ৫৫ ঘণ্টা বাড়ি অবরুদ্ধ করে তল্লাশি ও জেরার পরে গ্রেপ্তার করা হয় কোটি কোটি টাকা মালিক বনে যায় এই চালকল ও আটাকলের মালিককে। বাকিবুরের সঙ্গে প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতার অভিযোগও সামনে এসেছে। যদিও মন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন। তবে খাদ্য দপ্তরে যোগসাজশ ছাড়া এই দুর্নীতি কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরাও। তিন বছর ধরে পুলিশি অভিযান, তল্লাশির পরেও ওই একই জায়গায় রমরম করে চলছিল রেশনের কালোবাজারি। শীর্ষ প্রভাবশালী মহলের, খাদ্য দপ্তরের মাথার যোগ ছাড়া তা সম্ভব নয় বলেই আদালতে জানায় ইডি।
শুধু তাই নয় ইডি’র দাবি রেশন দুর্নীতির টাকাও বিদেশে সরানো হয়েছে। চলতি মাসে পুজোর সময়েই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ধৃত বাকিবুর রহমান দুবাইতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ইডি’ আদালতে জানায় বাকিবুর দুবাইতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, তার আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুবাইতেই তার বিনিয়োগ আছে বলে দাবি তদন্তকারী সংস্থার। সরকারি একাধিক দপ্তরের স্ট্যাম্প কী করে বাকিবুরের রাইস মিলে উদ্ধার হলো তা নিয়ে আদালতে একাধিক প্রশ্ন তোলে ইডি।
রেশনে আটা বণ্টরের বেনজির দুর্নীতির ১০ কোটির বেশি টাকা ঢুকেছিল বাকিবুরের সংস্থা এনপিজি রাইসমিলের অ্যাকাউন্টে। গুডলাইফ ডিলার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামে বাকিবুরের আরেকটি সংস্থায় ঢুকেছিল ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা, ইউনিকন কমোডিটি নামে আরেকটি সংস্থায় কোভিড পর্বেই ঢুকেছিল প্রায় ১২কোটি টাকা, ত্রিমুর্তি ইনফ্রা ডেভলপার্স নামে একটি সংস্থায় ১৪কোটি টাকা ঢুকেছিলে । আদালতেও তা জানায় ইডি। তদন্তকারী সংস্থার দাবি রেশন সামগ্রী বণ্টনের গোটা কারবার চলতো চেন সিস্টেমে। মিল মালিক, ডিস্ট্রিবিউটার, ডিলার- এই চক্রে আছে।মিড ডে মিলের কোটা থেকেও খাদ্য সামগ্রী লুট হয়েছে, তার জায়গায় নিম্ন মানে চাল,গম সরবরাহ করা হত। খাদ্য সাথী প্রকল্পের দুর্নীতির ভয়াবহ ছবি উঠে আসছে বাকিবুর রহমানকে জেরা করেই। ২০১৬ সালে জানুয়ারি মাস থেকে এই খাদ্য সাথী প্রকল্প চালু করে তৃণমূল সরকার।
Food scam West Bengal
রেশন দুর্নীতির জাল ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পে
×
Comments :0