কলকাতা, ১৪ অক্টোবর— সঙ্কীর্ণ স্বার্থে মেট্রো রেলের রুট বদলের জেরে বউবাজারে ঘনঘন ভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষ। বৃহস্পতিবার শেষরাতে ফের ফাটল দেখা দিয়েছে মদন দত্ত লেনের অনেকগুলি বাড়িতে। পুলিশ এবং দমকলের বাহিনী এসে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে গেলেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকায়। শুক্রবার সকালেই এলাকায় এসে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলি ঘুরে দেখেছেন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিম বলেছেন, ‘এটা কোনও দুর্ঘটনা নয়। এটা একজন নির্দিষ্ট ওম্যান-মেড ডিসেস্টার, মুখ্যমন্ত্রীই দায়ী এই ঘটনার জন্য। তিনি প্রোমোটার সিন্ডিকেটরাজের দৌলতে মুনাফার লোভে জেদ ধরে মেট্রোর রুট বদলেছেন। তার জন্যই বারবার ঘটে চলেছে।’
এই নিয়ে তিনবার বিপর্যয় ঘটল বউবাজারে অবৈজ্ঞানিক রুটে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গের নির্মাণকাজের জেরে। ২০১৯ সালের আগস্টে গভীর রাতে দুর্গা পিতুরি লেন এবং সেকরাপাড়া লেনের একাধিক বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। ঘরছাড়া হন এলাকার কয়েকশো বাসিন্দা, উঠতে হয় হোটেলে। এর পরে এই বছরের ১১ মে ফের ভাঙনের পুনরাবৃত্তি হয়। পাঁচমাসের মধ্যে ফের বৃহস্পতিবার ভাঙন এবং ফাটল দেখা গেল, এবার মদন দত্ত লেনে। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে এখন মেট্রো রেলের কর্তৃপক্ষ এবং ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। মেট্রোর ইঞ্জিনিয়াররা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এলে পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাঁদের পাহারার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের রোষ থেকে বাঁচাতে। কিন্তু বারবার ভাঙনের পিছনে প্রকৃত দায়ী কে, এদিন তা ঘটনাস্থলে এসে সরাসরি বলে গিয়েছেন মহম্মদ সেলিম।
শুক্রবার সকালেই সেলিম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যান এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির সদস্য মধুজা সেন রায় ও তরুণ ব্যানার্জি। অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার দাবিকে সমর্থন করেছেন তাঁরা। বাসিন্দারাও তাঁদের বলেছেন, হোটেলে গিয়ে থাকা কোনও সমাধান নয়। আমরা সরকারের কাছে সমাধান চাই। সেলিম সাংবাদিকদের বলেছেন, বারবার কেন এমন ঘটছে? এটা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটা একজন নির্দিষ্ট ওম্যান-মেড ডিজাস্টার।
কীভাবে মুখ্যমন্ত্রী এই বিপর্যয় ডেকে এনেছেন তা ব্যাখ্যা করে সেলিম বলেছেন, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ইউপিএ সরকারের সময়ে। আমি তখন উত্তর-পূর্ব কলকাতার সাংসদ হিসাবে পার্লামেন্টের আর্বান স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। আমরা বামপন্থীরা লড়াই করে এই প্রকল্প আদায় করেছিলাম কলকাতার জন্য। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর জন্য শিয়ালদহ হাওড়ার মাঝে যে রাস্তা আছে সেই বউবাজার স্ট্রিটের তলা দিয়ে টানেল করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু আজকে যিনি এখানকার সাংসদ (সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়) তখন তিনি উত্তর-পশ্চিম কলকাতার তৃণমূল সাংসদ ছিলেন, তিনি মমতা ব্যানার্জির পরামর্শ মতো সঙ্কীর্ণ স্বার্থে সিআইটি’র দখল করা জমি দখলে রাখতে দলনেত্রীর কাটআউট লাগিয়ে বলেছিলেন এখান দিয়ে মেট্রো রেল করা যাবে না। তখন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো ছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ প্রকল্প, রেল মন্ত্রকের প্রকল্প ছিল না। মমতা ব্যানার্জি তার পরে রেল মন্ত্রী হয়ে শিয়ালদহে মেট্রোর স্টেশনের কাজ করতে দেননি। তাঁর জেদের জন্য রাস্তার তলা দিয়ে নির্মাণ কাজ করা যায়নি। বরং রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ প্রকল্প রেল দপ্তর নিজের হাতে নিয়ে নেয় এবং মমতা ব্যানার্জি ঠিক করে দেন ধর্মতলার কার্জন পার্ক দিয়ে মেট্রোর রুট যাবে।
সেলিম বলেন, মুখ্যমন্ত্রী গান গাইতে জানেন, ছবি আঁকতে জানেন, মন্ত্রোচ্চারণ করতে জানেন, কিন্তু ভূতত্ত্ব তো আর জানেন না। তার জন্য ভূতাত্ত্বিক, সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা রয়েছেন। তাঁরা আগেই বলেছিলেন পুরানো কলকাতার যা মাটি তাতে বসতবাড়ির নিচ দিয়ে মেট্রোর টানেল যেতে পারে না। জলা জমিতে গঙ্গার কাদা দিয়ে ভরাট করে এখানে বসতি গড়ে উঠেছে, তার নিচে টানেল হলে বিপর্যয় হবে। এই জন্যই দমদম-টালিগঞ্জ মেট্রো রেল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, জওহরলাল নেহরু রোড, এসপি মুখার্জি রোড ইত্যাদি রাস্তার তলা দিয়ে হয়েছে, বাকি এলাকায় থাম তুলে তার ওপর দিয়ে মেট্রো গেছে। বৌবাজারে রাস্তার তলা দিয়ে মেট্রো না করে বসত এলাকার মাটির তলা দিয়ে মেট্রোর রুট করলে বাড়িগুলিতে বিপদ হবে, বিশেষজ্ঞদের এই কথা মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে চাননি কেন?
এর পিছনেই কেলেঙ্কারির অভিযোগ করে সেলিম বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী রুট বদলে ধর্মতলার কার্জন পার্ক দিয়ে মেট্রো করিয়েছেন, কারণ তিনি মেট্রো রেলের বাহানায় কার্জন পার্কে শপিং কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে চান। তার জন্যই ট্রাম ডিপো বন্ধ করে জমি দেওয়া হয়েছে। ডেভলপার, প্রোমোটার সিন্ডিকেট রাজের স্বার্থে জেদ করে মেট্রোর রুট পালটে স্ক্যাম হয়েছে, তার খেসারত দিতে হচ্ছে বউবাজারের বাড়িগুলির পরিবারগুলিকে। আশেপাশের বাড়িতে নিয়মিত ফাটল ধরছে, কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারছেন না। এখানকার মানুষের রোষ মুখ্যমন্ত্রী টের পাবেন।
Metro Rail
বউবাজারে ফের বাড়িতে ফাটল
×
Comments :0