স্বস্তিক সরকার
'সম্পর্ক' - এমন একটি শব্দ যা সমস্ত যুদ্ধ, হিংসা, রাগ, প্রতিশোধের বিপক্ষে একা দাঁড়িয়ে থাকে দৃঢ় ভাবে। আমাদের বেঁচে থাকার এক মস্ত বড় সম্বল এই শব্দটা। শত শত মৃত্যু মিছিল অতিক্রম করেও মানুষ থেকে যায়। আর থেকে যায় সম্পর্ক। এই ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না। এই সম্পর্ক ঠুনকো আঘাতে চিড় ধরে না। মানবতা থেকে যায়, সহিষ্ণুতা থেকে যায়, মননশীলতা থেকে যায়। মানুষ সেই আদিম কাল থেকেই সঙ্ঘবদ্ধ জীব। এই সঙ্ঘবদ্ধতা মানুষের সম্পদ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সঙ্ঘবদ্ধতা বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে বহুবার। আর এই বিপ্লবকে ভয় পায় কিছু মানুষ। যারা জানে দশ হাত এক হলে প্রান্তিক মানুষ ইতিহাসের পাতায় উঠে আসবে। তাই হিংসা-বিবাদ ছড়িয়ে তারা সামাজিক ভাঙন ধরাতে চায় বারবার।
চলচ্চিত্র গণমাধ্যম হিসেবে এক শক্তিশালী ক্ষেত্র। অন্যান্য মাধ্যমের মতোই বিশ্ব ইতিহাসে রাজনৈতিক স্বার্থে সিনেমা ব্যবহৃত হয়েছে বহুবারই। এক শ্রেণি যেমন মানুষকে জোটবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে সিনেমাকে, আরেক শ্রেণি তেমনি ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করেই। তবে বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে থেকে গেছে সেই ছবিই যা প্রান্তিক মানুষের কথা বলে।
ভারত এমন এক দেশ যা বহুত্বের সংস্কৃতিকে বয়ে চলেছে। এদেশের শিল্প মাধ্যম ব্যবহার করে যারা ভাঙনের রাজনীতি প্রচারের চেষ্টা করেছে তাদের ইতিহাস মনে রাখেনি। আজ চলচ্চিত্রে মুসলিমবিদ্বেষী বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি অংশ। এই ধরনের বিভিন্ন সিনেমার উল্টোদিকেও তৈরি হচ্ছে বহু ছবি যা সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে চলেছে লাগাতার।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে ইসলাম ধর্মাবলম্বী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সংখ্যা কম এ কথা ঠিক। বাংলার মহানায়ক উত্তমকুমারকে পর্তুগিজ খ্রীষ্টান চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেলেও গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। ছবিতে শাহরুখ খানের চরিত্রের নাম ‘রাজ’ এবং ‘রাহুল’ ব্যবহার করা হয়েছে বারবার, ‘কবির’ বা ‘আনোয়ার’ নয়। তবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য বহু চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে বিমলের (কালী ব্যানার্জি) ন্যাওটা শিশুটি ছিল মুসলমান। যে শিশু আগামীর প্রতিনিধি। ভবিষ্যতের প্রতীক। সত্যজিৎ রায়ের 'জলসাঘর' ছবিতে ওস্তাদ উজির খান (ওস্তাদ ওয়াহেদ খান) নামক চরিত্র আমরা দেখেছি।
১৯৫৭ সালে রবি ঠাকুরের ছোট গল্প অবলম্বনে পরিচালক তপন সিনহা তৈরি করেন 'কাবুলিওয়ালা'। ১৮৯২ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া 'কাবুলিওয়ালা' গল্প হিসাবে প্রত্যেক যুগে এতটাই প্রাসঙ্গিক যে তপন সিনহার পর একাধিকবার এই গল্প অবলম্বনে ছবি তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে বলরাজ সাহানি অভিনীত ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৬১) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে ‘রহমত’ চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় আজও কাল্ট।
স্বাধীনতার পরপরই ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে “নন-অ্যালাইনমেন্ট” বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছিল। আফগানিস্তান ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্র ছিল। এক আফগান ফেরিওয়ালার কাহিনি ভারতীয় সমাজে ‘বিদেশি‘ মানুষকে মানবিক দৃষ্টিতে বোঝার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
তপন সিনহা এই ছবি শুরু করেন ভাষ্যের মাধ্যমে। এই ভাষ্যে উঠে আসে সনাতনী ইতিহাস এবং প্রান্তিক ইতিহাসের দ্বন্দ্বের কথা। আফগানিস্তানের দুর্গম এক পথের দৃশ্য দেখা যায়। সাধারণ কিছু পথিক উটের পিঠে অতিক্রম করছে সেই দুর্গম পথ। যেন ইতিহাসের ছায়াপথ ধরে হাঁটছে তারা। এই মানুষদের কথা ইতিহাসে থাকে না। ভাষ্যে বলা হয় তাদের যাত্রা শেষ হবে হিন্দুস্তানে। কর্ম সংস্থানের আশায় শিকড় ছাড়া মানুষের চিরন্তন গাঁথা। হালে যাদের 'পরিযায়ী শ্রমিক' তকমা দেওয়া হয়েছে। এই দৃশ্যে খানিক পরে আফগানদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। দৃশ্যে দেখা যায় প্রবল শ্রমে পাথুরে জমি কেটে তারা ফসল ফলানোর চেষ্টা করছে। সিন্ধুর ওপারে হিন্দুস্তান তাদের কাছে এক স্বপ্ন নগরী। যে দেশ থেকে মেঘ ভেসে আসার আশায় বুক বেঁধে থাকে আফগানরা। কিন্তু আফগানিস্তানে পৌঁছানোর আগেই সেই মেঘ শুকিয়ে যায়। এই পথিক দলের একজন রহমত। সেও চলেছে হিন্দুস্তানে। এই যাত্রা তার কাছে বিষাদময়। সে ছেড়ে আসছে তার মেয়ে রাবেয়াকে। ভাষ্যে বলা হচ্ছে নিজের আত্মীয় স্বজন, তুষার শৃঙ্গের সৌন্দর্য, চিনার বনের অপূর্ব মাধুরী ছাপিয়ে বারবার তার মেয়ে রাবেয়ার মুখ ভেসে উঠছে রহমতের চোখের সামনে।
ছবির পরবর্তী সময়ে এই মেয়ের ছায়াই কলকাতার রাস্তার ফেরিওয়ালা রহমতের সাথে বন্ধুত্ব হওয়া এক ছোট্ট মেয়ে মিনির মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ১৯৫০-এর দশকের কলকাতা দ্রুত নগরায়ন, রাজনৈতিক অস্থিরতা (খাদ্য আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, শরণার্থী সমস্যা)–র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে ছোট মেয়ে মিনি ও এক প্রবাসী আফগান ফেরিওয়ালার সম্পর্কের কাহিনি মানুষকে মানবিকতার শিকড়ে ফিরিয়ে আনার মতো হয়ে দাঁড়ায়।
গল্পে মিনির মা এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে সংকীর্ণতার ছায়া দেখা যায়। দেখা যায় ভিনদেশী মানুষের প্রতি সন্দেহ, অবহেলার ছবি। কিন্তু এই সংকীর্ণতা কাটিয়ে থেকে যায় সম্পর্ক। এক ভিনদেশী ফেরিওয়ালার সাথে একটি শিশুর স্বার্থহীন বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বে জাত নেই, ধর্ম নেই, অসহিষ্ণুতা নেই। আছে শুধু মানবতা। ভাঙনের বিপক্ষে ভালোবাসা। রহমতকে মিনি ভুলে যায় সময়ের নিয়মে। কিন্তু রহমত থেকে যায় সময়ের বন্ধু হয়ে। মনে রেখে দেয় সবকিছু যত্ন করে। গল্প শেষে এক মন-কেমন ছড়িয়ে যায় চারপাশে ঠিকই। কিন্তু তার মাঝেও মনে হয় রহমতকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। রহমতদের মনে রেখে দেওয়া জরুরি।
Comments :0