শিল্প উৎপাদন কমতে কমতে এখন একটা বন্ধ্যা অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর মূল কারণ হলো দেশে আয়ে এক চরম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। একদিকে সমাজের মুষ্টিমেয় ধনীদের হাতে বিপুল সম্পদ জড়ো হচ্ছে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় কমছে। ফলে শিল্পজাত পণ্যের বাজার কমছে, এতেই শিল্পের উৎপাদন কমে এখন একটা বন্ধ্যা অবস্থা তৈরি হয়েছে। শিল্পের উৎপাদনে এই অধোগতি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিরল। দেশে বর্তমান শিল্প সঙ্কট নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক।
প্রসঙ্গত জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর(এনএসও) প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্টে গত অক্টোবরে শিল্পে উৎপাদন হার গত বছরের থেকে ৪শতাংশ হারে কমে আসায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পে উৎপাদনে অধোগতির হার বেড়ে চলা নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। করোনায় লকডাউনের ফলে শিল্প বাণিজ্য বন্ধ থাকায় আর্থিক বৃদ্ধির হার স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তা মিটে গিয়ে সব স্বাভাবিক হওয়ার পর এক দফায় শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির পর কেন ফের শিল্পে উৎপাদন হ্রাস? কেন শিল্পের উৎপাদনে এই বন্ধ্যা? এই প্রশ্নের কোনও জবাব নেই খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন থেকে সরকারের তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞদের এতে মুখে কুলুপ। পট্টনায়েক এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন দেশের অর্থনীতির বন্ধ্যা অবস্থা নিয়ে এক প্রতিবেদনে। তিনি তাতে বলেছেন, বর্তমান ভারত সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাওয়া নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইছে না। এই সমস্যা নিয়ে সরকারের কোনও কথাই শোনা যাচ্ছে না। সরকার মাঝে মাঝে শিল্প উৎপাদনের ভিত্তিবর্ষ পরিবর্তন করে উৎপাদন বৃদ্ধির হার বেশি দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে দেখা গেছে, নয়া উদারবাদের সময় জুড়ে শিল্পে উৎপান বৃদ্ধি হার কমেই চলেছে। তিনি বলেন,সরকারের হিসাব মতো ভিত্তি বর্ষ দিয়ে বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে শিল্পে উৎপাদন কমেছে নয়া উদারবাদের আমলেই। যেমন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ সাল গড় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির(জিডিপি) হার ছিল ৭শতাংশ। যদিও এই হারকে বন্ধ্যা হার বলে মনে করতেন উদারবাদী অর্থনীতিবিদরা। উদারবাদীর পথে চলার পর দেখা গেল উৎপাদন শুধু বন্ধ্যা নয় এবারে কমতে শুরু করেছে বৃদ্ধির হার। যেমন ২০১১-১২ থেকে ২০১৮-২০দেশে মোট শিল্প উৎপাদন বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এতে শিল্পে গড় বৃদ্ধির হার হলো ৩.২শতাংশ। পট্টনায়েক বলেন, এই বৃদ্ধি হার শুধু কম নয় কোনও বছরেই শিল্পে এতো কম হারে উৎপাদন দেখা যায়নি। ১৯৫১ সালকে ভিত্তবর্ষ ধরে হিসাব করলে ১৯৬৫ সালে শিল্পে গড় উৎপাদন বৃদ্ধি হার হয় ৭শতাংশ। এবারে ২০০৪-৫ সাল থেকে ২০১৪-১৫ সালে ২০০৪-৫ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরলে গড় এই বৃদ্ধি হার হয় ৫.৮৭ শতাংশ। তিনি জানান সম্প্রতি আমরা শিল্পে এই বিপুল অধোগতি প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে উদারবাদের আমলেই শিল্পে উৎপাদন কমেই চলছে। যদিও উদারবাদীরা তাদের আমলেই শিল্পের বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে বলে যে দাবি করে এসেছে তা যে পুরো ভুল তা এই তথ্য প্রমাণ করছে। চলতি অক্টোবরের শিল্পে উৎদাদনের বিপুল অধোগতি তা আরও স্পষ্ট করেছে।
এদিকে অর্থনীতিতে কোনও বিপর্যয়ে জোগান বন্ধ হয়ে গেলে শিল্পে একটা বন্ধ্যা অবস্থা তৈরি হয়। বিপর্যয় কেটে সব স্বাভাবিক হলেই দেখা যায় বিপুল হারে বাজারে চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের সময় এই জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। যুদ্ধ থেমে গিয়ে সব স্বাভাবিক হলে ফের বিপুল চাহিদা বেড়ে গিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মহামারীতে ভারতে দেখা গেল উলটো চিত্র। যুদ্ধের মতো অবস্থায় মহামারীতে সব বন্ধ হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। এবারে সব স্বাভাবিক হলেও দেখা গেল চাহিদায় আর সেই বিপুল হারে বৃদ্ধি দেখা গেল না। চাহিদা আরও কমে গেল। এতে দেখা যাচ্ছে শিল্পের উৎপাদনে এক বন্ধ্যা অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এদিকে কেন শিল্পে এই বন্ধ্যা? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দেশে আয়ের বৈষম্যের কথাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন পট্টনায়েক। তিনি বলেন, এখানে দু’টো বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক হলো শিল্প তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার পাচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণ মানুষের আয়ে চরম বৈষম্য। ধনী মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সব সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় প্রতিদিন কমছে। শিল্পজাত পণ্যের বাজার নির্ভর করে সাধারণ মানুষের কেনাকাটার উপর। সামান্য ধনীদের কেনাকাটার জন্য বাজারের চাহিদা নির্ভর করে না। পট্টনায়েক বলেন, ২০১৪-১৫ সাল থেকে মানুষের আয় কমে যাওয়ার প্রবণতা বিপুল হারে বেড়েছে। ২০১৭-১৮সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গেছে (এই রিপোর্ট সরকার চেপে যায় পরে তা দৈনিকে ফাঁস হয়ে যায়) ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮সালে গ্রামীণ ভারতে মাথাপিছু খরচ ৯শতাংশ হারে কমে যায়। গ্রামের গরিব শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে যাওয়াতে খরচ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। গ্রামের ধনীদের এখানে আয় কমার কোনও প্রশ্ন আসে না। গ্রামে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ার কারণে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা কমে যায়। এদিকে গ্রামের মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তারা কাজের খোঁজে শহরে চলে আসেন। এতে শহরে কাজের চেয়ে কাজের জন্য চাহিদা বিপুল হারে বেড়ে চলায় শহরে মজুরির হার কমতে থাকে। ফলে গ্রামের মতো শহরেও শ্রমজীবীদের আয় কমে আসায় শহরেও শিল্পজাত পণ্যের বাজার কমে যায়। বাজারের অভাবে এতে অনিবার্য ভাবেই শিল্পের উৎপাদন কমতে কমতে কার্যত তা বন্ধ্যা অবস্থায় চলে এসেছে।
আয় বাড়িয়ে চাহিদা বাড়াতে কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানান পট্টনায়েক। তিনি বলেন, নতুন কাজ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের আয় বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশে পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল সরকারি বিনিয়োগ করা দরকার কেন্দ্রের। রাষ্টয়াত্ত ব্যাঙ্কের থেকে সরকার ঋণ নিয়ে তা পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করা উচিত। যদিও কেন্দ্রের নীতিতে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। এক্ষেত্রে বিশেষ সরকারি আর্থিক সংস্থার থেকে কেন্দ্রের ঋণ নিয়ে পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করা উচিত। এই বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ফেরানোর লক্ষ্যে হওয়া উচিত। এতে নতুন কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে। শিল্প পণ্য বিক্রির বাজার ফিরে পাবে। শিল্পে বন্ধ্যাও কেটে যাবে।
Economy
আয় বৈষম্যের জন্যই শিল্পে বন্ধ্যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
×
Comments :0