প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
এ প্রশ্ন বহুদিনের। একটা সময় ছিল যখন স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বাংলা ছবিতে হাস্যরস আসত। চিত্রনাট্যকার বা পরিচালক অনেকখানি জায়গা রাখতেন হাস্যরসের শিল্পীদের জন্য। বাঘা বাঘা কমেডিয়ানরা সেই জায়গাকে স্মরণীয় করে দিতেন নিজেদের বাড়তি সংযোজন দিয়ে।
অনেক সময়ই তেমন কোনও মুহূর্ত তৈরি থাকত না চিত্রনাট্যে, থাকত না পরিচালকের মাথাতেও। এই দায়িত্বটুকু নিজেরাই নিয়ে মানুষের মনের অন্দরে ঢুকে যেতেন তাঁরা। এমন নাম বহু রয়েছে। তবে সবাইকেই এখানে আনা সম্ভব নয়। তাই কয়েকজনের কথা তুলে ধরা যায়। যেমন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার, তুলসি চক্রবর্তী প্রমুখ। ইদানিং কালের খরাজ মুখার্জি শুভাশিস মুখার্জি, কাঞ্চন মল্লিক, বিশ্বনাথ বসু। আর বিশেষ ভাবে নাম করা যায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
পুরানোদের নিয়ে কয়েকটি মুহূর্তের চিত্রস্মৃতি এখানে তুলে ধরা যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত বলিষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল তাঁকে নিয়ে একক ভাবে কমেডি ছবি করা। হাস্যরসের কত বড় স্তম্ভ হলে তবেই একটা গোটা কমেডি ছবি একার কাঁধে বহন করা যায়! সেই কমেডি স্তম্ভ ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। একেবারে কোনও ভাড়ামি নেই। সাধারণ অভিনয়ে কৃত্রিম উপায়ে নয় স্বাভাবিক ছন্দে তিনি হাস্যরস পরিবেশন করে গেছেন এবং বাংলা ছবিকে ধনী করে গেছেন। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এই একটা ছবির উদাহরণই তার পক্ষে যথেষ্ট।
সেই সময় ধরে বললে, শীতল বন্দ্যাপাধ্যায়কে ধরতেই হয়। অনেক ছবিতেই তাঁর ছোট ছোট অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। একটা ছোট্ট দৃশ্যের অবতারণা এখানে করা যায়। ‘শাপমোচন’ ছবির একটি ফেলনা দৃশ্যের মতই মনে হবে দৃশ্যটাকে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্যটিতে অসাধারণ অভিব্যক্তিতে খিলখিল হাসি মাখিয়ে দর্শক মনে তা স্মরণীয় করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই দৃশ্যটি। যখন মেসে দেখা করতে গিয়ে উত্তম কুমারকে না পেয়ে সুচিত্রা সেন ভীষণ রাগে একটা চিরকুট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন বারান্দায়। সেখানে অনেককেই ছিলেন, মানে দৃশ্যটি সেই মুন্সিয়ানাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল। চিরকুটের ছেঁড়া অংশগুলো যখন মেঝেয় ধূলায় ধূসরিত তখন সুন্দরীর পরশমাখা কাগজের টুকরেগুলো হাঁটু গেঁড়ে বসে পরম যত্নে তুলে নিচ্ছিলেন শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক নামি শিল্পীদের সমাহারে দৃশ্যটি রচিত হয়েছিল। কিন্তু দর্শক চোখ আর মন কেড়ে নিয়েছিলেন শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিপুণ হাস্যরসের অভিনয়ের মাধ্যম।
বহু ছবির বহু দৃশ্য অভিনয়ের মুন্সিয়ানায় স্মরণীয় করে রেখেছেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সে সব দৃশ্য নয়, একটি ক্ষণিকের অভিনয় দৃশ্যের কথা আমি বলতে চাইছি। একটি নামি ছবির দৃশ্যে খুবই কম সময়ের জন্য নৃপতি চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন। পাওনাদারের রোলে। তিনি সেই লোকটির বাড়ি আসছেন যার কাছে তিনি টাকা পাবেন। এদিকে নৃপতিবাবুকে দেখে লোকটি বন্ধ দরজা খোলারও সময় না পেয়ে নিজের বাড়ির পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছেন। পিছনে এসে পড়েছেন নৃপতিবাবু। তার হাতে প্রাচীন কালের শতছিন্ন একটি ছাতা। তিনি দরজার নিচে দাঁড়িয়ে ওই লোকটিকে ছাতার গোঁজা মারছিলেন।সেই দৃশ্যকল্প সম্ভবত সর্বদিক দিয়ে মানে এই অসাধারণ অভিব্যক্তি ও হাস্যরস তৈরি করা তাঁর দ্বারাই সম্ভব ছিল। নৃপতিবাবু ছিলেন দাশর্নিক মানুষ। নিজের অভিনয়ের প্রতি নিজেই উদাসীন ছিলেন।
জহর রায়ের কথা তুলে ধরা যাক। সামান্য একটি উদারণই যথেষ্ট। অর্ধেন্দু মুখার্জি তাঁর ‘পূর্বরাগ’র একটা ছোট্ট দৃশ্যে জহর রায়কে ঢুকিয়ে দিলেন। একে জহর রায়ের প্রথম ছবি তার ওপর ছোট্ট রোল। জহর রায়ের স্বভাব হল এক্সটেম্পোর দেওয়া। তাই জহর রায় বেশ কয়েকটা কথা ঢুকিয়ে দিলেন বাড়তি। অর্ধেন্দুবাবু রাগ করেননি বরং সাদরে সেটি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এই এক্সটেম্পোর বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছিল, তিনি ডায়লগ বলে যেতেন বাড়তি। সহশিল্পীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু দর্শকরা এনজয় করতেন বলে কোনও পরিচালকই তাঁকে কোনওদিন কিছু বলেননি। জহর রায় এক্সটেম্পোর দিয়ে গেছেন আর দর্শকরা গিলে খেয়েছেন।
বহু বর্ণে, বহু ভঙ্গিমাতে ধরা যায় রবি ঘোষকে। তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছিল নানা শুটিংয়ে। কন্ঠকে অদ্ভুৎ ভাবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। শুধু কন্ঠের ওঠাপড়ায় অনেক সময় হা হা হাসি এনে দিয়েছেন দর্শক মনে। তাঁর মৃত্যুর দিন আমি ওঁর শুটিংফ্লোরে ছিলাম। তপন সিংহর ‘সিঁদেল চোর’র শুংটি করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন মেক আপম্যান দেবী হালদারই প্রথম ওনাকে অসুস্থ হতে দেখে খবর দিয়েছিলেন সবাইকে। কারণ সেই সময় ছিল লাঞ্চ টাইম। তারপর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, আর ফেরেননি।
রবি ঘোষের হাস্যরসের বিস্তৃতি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম। তাই তাঁকে ছোট্ট কথায় ধরা মুশকিল। নিজের কথা দিয়ে নয়। একটাই কথা তুলে ধরব বিশিষ্ট পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বহুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। কয়েকবার তাঁর ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তাঁর বহু ছবিতে নামি নামি শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন। বিভিন্ন কমেডি অভিনেতাদের নিয়ে বলতে গিয়ে বারবার তিনি রবি ঘোষের কথায় ফিরতেন। বলেছিলেন সব ছবির কথা আনার প্রয়োজন নেই, ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির রেফারির কথা ভাবলেন দেখবেন আপনিই হাসি এসে যায়। একজন কমেডি অভিনেতার জয় এটাই। অথবা হালকা হাসির ছবি ‘ব্রজবুলি’র কথা ভাবতে পারেন আপনারা।
এভাবেই ষাট, সত্তর, আশির দশকের অনেক কমেডি অভিনেতার কথা তুলে আনা যায়। যাঁরা স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের ভুরি ভুরি হাসি উপহার দিয়ে গেছেন। এই স্বাভাবিক হাসিটাই এখন বাংলা ছবি থেকে হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এখন তৈরি করা হয় যে কজন আছেন তাদের নিয়ে রিলিফ চরিত্র। তবে তার মধ্যে থেকেও তৈরি হয় দু’একটা হীরের টুকরো। কিন্তু এত বেশি অস্বচ্ছন্দে তাঁদের বেঁধে ফেলা হয় যে, তাঁদের মানে বর্তমান সময়ের হাস্যরস অভিনেতাদের কিছুই করার থাকে না।
বাংলা ছবি দেখতে বসলে যখন নানা দুর্বলতার কারণে ক্লান্তি আসে। তখন পাওয়া যায় না সেই সব অভিনেতাদের, তৈরি হয় না অবিস্মরীয় হাসির সেই সব মুহূর্ত বা ‘সেই হাসি’ যা অমলিন হয়ে বুকের ভিতরে বেঁচে থাকবে আজীবন না হলেও কয়েক দশক। তাই কেউ আর সাহস করে ভাবেন না শুধু একটা কমেডি ছবির কথা। কারণ টেনে নিয়ে যাবার মত শিল্পী কই? তাই আপাতত বাংলা কমেডি ছবির ঘরে পড়ে থাকে শব্দহীন শূন্যতা।
Comments :0