MY TEACHER

মাস্টারমশাই

রাজ্য বিশেষ বিভাগ

MY TEACHER

প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়

সব মামারাই শিক্ষক আমাদের তাই কোনওদিন বাইরে কোথাও টিউশন পড়তে যেতে হয়নি। কিন্তু একজন মাস্টারমশাই আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করলেন। তাঁর নাম অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ছোটমামার স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। 

একদিন ছোটমামাকে বললেন, তোমাদের বাড়ির পরিবেশটি আমার চমৎকার লাগে ভাই। যদি একটা কথা রাখো ভালো হয়। মামা বললেন, বলো কি কথা? মাস্টারমশাই বললেন, আমি তোমাদের বাড়ি গিয়ে সপ্তাহে চার/পাঁচদিন বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াতে চাই। ছোটমামা বললেন, তোমার মতো শিক্ষক ওদের দায়িত্ব নিলে আমরা বর্তে যাই। মাস্টারমশাই বললেন, আমি কিন্তু কোনও পারিশ্রমিক নেব না। আর এই শর্তে তোমাদের রাজি হতে হবে। 

ছোটমামা বললেন, তা কী করে হয়! কিছু তো তোমাকে নিতেই হবে। মূল্য না দিলে শিক্ষা পূর্ণ হয় না। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হলেন সামান্য কিছু নিতে। আর আসতে শুরু করলেন আমাদের বাড়ি। 

বেশ লম্বা, রোগাটে, ফর্সা মানুষ। পড়তেন ধুতি আর হাঁটু ছাপিয়ে যাওয়া পাঞ্জাবি। মুখে অনাবিল হাসি লেগেই থাকত, যা ফুরাবার নয়। মাস্টারমশাইয়ের বড় গুণ ছিল, তিনি সব বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তবে মূলত ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক। আমাদের সব সময় জানোয়ার বলতেন। তারপর বলতেন, কিছু মনে করলি নাকি? প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি হাজির হতেন আমাদের বাড়ি। দালানের কোণায় একটা ঘর ছিল সেখানে তিনি আমাদের সকলকে একসঙ্গে পড়াতেন। তার আগে এই দায়িত্ব পালন করতেন ছোটমামা। 

মাস্টারমশাই এলেই তাঁকে বড় থালা করে গোল পাঁপড় ভেজে দিত হত। তার সঙ্গে চা। খুব ভালোবাসতেন পাঁপড় ভাজা খেতে। তাঁকে দেওয়া হলে তিনি তা থেকে আমাদের ভেঙে ভেঙে দিতেন। তারপর পড়ানো শুরু করতেন। অঙ্ক নিয়ে ঝামেলা হত বিস্তর আর তিনি ফর্মুলা বুঝিয়ে আমাদের অঙ্ক কষতে দিতেন। না পারলে দুঘা কষাতে কসুর করতেন না। যাওয়ার সময় মারের জন্য আমাদের আদর বাড়তি পাওনা হত। কোনও কোনওদিন তিনি এসেই সরু গলায় আবৃত্তি শুরু করতেন। ওই বয়সে কুমোর পাড়ার গরুরগাড়ি তাঁর কন্ঠে শুনতে খুব ভালো লাগত। তাছাড়া সুর করে আবৃত্তি করতেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। কখনও বা গল্প নিয়ে পড়তেন। তাঁর মুখে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প শুনেই তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। গড়গড় করে ওনার গল্প তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাদের শোনাতেন। কখনও বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের তিনজনের গল্পই তিনি বেশি বলতেন। যার ফলে সেই থেকে সাহিত্য প্রীতি জন্মেছিল আমার। বিশেষ করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের তীব্র নেশা ছিল আমার। 

ওনার অদ্ভুত লেখা আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাকে পাগল করে তুলেছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন মাস্টারমশাই। কিন্তু সাহিত্যে তাঁর দখল ছিল সাংঘাতিক। 

 

ওনার আসার কথা সন্ধ্যা ছটায়। উনি চলে আসতেন বিকাল চারটেয় আমাদের খেলার মাঠে। তখন আমরা ফুটবল খেলছি। মাস্টারমশাই সাইড লাইনের ধার থেকে চিৎকার করছেন রাইট উইংঙ্গারকে দে। আমাদের বন্ধু আভাস ওই পজিশনে খেলত। ওকে আমরা তখন ‘বিদেশ বোস’ বলতাম। আমরা ছোট তখন, বিদেশ বোসের খেলা ভালো লাগত। মাথা নামিয়ে হয়ে ছুটতেন বল পেলে। আভাসও তেমন, বল পেয়ে গেলেই হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। মাস্টারমশাই চিৎকার করতেন, স্বপনকে দে, স্বপনকে দে। স্বপন স্ট্রাইকারে খেলত। শেষ পর্যন্ত গোল হত না। মাস্টারমশাই চিৎকার করতেন, জানোয়ার কোথাকার। অঙ্কটা ঠিক কষে উত্তরটা ভুল করে ফেললি! 

আমরা যতক্ষণ খেলতাম ততক্ষণই উনি সাইড লাইনের ধার থেকে চিৎকার করতেন। কি আশ্চর্য। তারপর আমাদের সঙ্গে বাড়িতে এসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পড়াতে বসতেন। বলতেন, ইতিহাস পড়াব আজ। নাও ঠেলা। আমাদের কারোর সাল, দিনক্ষণ কিছুই মনে থাকত না। আর মাস্টারমশাই গড়গড় করে বলে যেতেন। ইতিহাসের এক একটা চ্যাপ্টার ধরে যেন মুখস্ত বলে যেতেন। কোনওদিন ইংরাজি নিয়ে পড়তেন, ‘ডেলি ড্রামা নাটক করে দেখাতেন। এই ছিলেন মাস্টারমশাই।

 

জুতো নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতানি ছিল। কিন্তু টাকার অভাবে দামি জুতো কিনতে পারতেন না। মামারা ভালো জুতো তাঁকে উপহার দিতেন। পায়ে গলাতে গলাতে শিশুর মতো হাসতেন। সেই হাসি ভোলা যায় না। আসলে মাস্টারমশাই খুব গরিব ছিলেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও একটিমাত্র মেয়ে পিঙ্কি। আমরা বলতাম পিঙ্কিদি। অসাধারণ মেধাবী মেয়ে সে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি আমরা কোনও কোনওদিন যেতাম। আমরা জেঠিমা বলতাম মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীকে। গেলেই তিনি আমাদের সবাইকে ছোট ছোট বাটিতে এক মুঠো করে মুড়ি আর ছোলাভাজা দিতেন। আমরা খেতাম। পিঙ্কিদি পাশে বসে থাকত। আমাদের চেয়ে খানিকটা বড়। বলত, মা আবার এসে তোদের জিজ্ঞেস করবে যে, আর ছোলাভাজা দেবে কিনা। তোরা ‘না’ বলবি। কারণ ঘরে আর ছোলাভাজা নেই। আর ঠিক খানিকটা পরে এসে জেঠিমা জিজ্ঞেস করতেন, আর ছোলাভাজা দেব? আমরা সম্মিলিত কন্ঠে বলতাম, না না, আর নেব না। জেঠিমা সঙ্গে সঙ্গে পিঙ্কিদির দিকে চেয়ে অদ্ভুত হেসে চলে যেতেন। মায়েরা বোধহয় সব বুঝতে পারেন।

মাস্টারমশাই পড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মনে ঢুকিয়ে দিতেন। কি চলছে চারদিকে, কোথায় কি ঘটছে। গ্রাম, শহরসহ রাজ্য ও সারা দেশে কি চলছে। কি নিয়ে কোথায় কি ঝামেলা চলছে বা দাবি উঠেছে। সব তিনি আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন এই কাজ করতেন। যাকে বলে প্রতিদিন আমাদের আপডেট করে দিতেন। চলন্ত খবরের কাগজ ছিলেন। আমরা তাঁর কাছে আজও কৃতজ্ঞ। 

সেদিনটার কথা ভুলব না। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মাস্টারমশাই কদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তিনি হঠাৎ মারা গেলেন। আমরা তাঁর বাড়িতে গেলাম। লম্বা মানুষটি শুয়ে আছেন বিছানায়। তখন বিকাল হচ্ছে। তাঁর ঘরের ভাঙা জানলা দিয়ে এক ফালি রোদ্দুর এসে পড়েছে শরীরে। যেন আনমনে খেলা করছে কঠিন কঠিন অঙ্ক নিয়ে ওই রোদ্দুর। খুব লম্বা ছিলেন। মলিন খাটটায় ধরতেন না। পা-টা খাটের বাইরে বেরিয়ে আছে। জেঠিমা গুম হয়ে আছেন। পিঙ্কিদি চিৎকার করে কাঁদছে। আর মাস্টারমশাইয়ের মুখে যেন হাসি লেগে আছে। সারাজীবন শিক্ষার জন্য প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন দারিদ্রতাকে। টাকার দিকে চাননি। টিউশন করে টাকাই নিতেন না। পড়ার খেয়ালে পড়িয়ে যেতেন। ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকরা টাকা দেবেন কিনা সে প্রশ্ন কোনওদিন করেননি। 

সেদিন বহু মানুষ তাঁর বাড়িতে এসেছেন। তারপর বাঁশের তৈরি খাটে তাঁকে উঠানো হল। কাঁধ দিয়েছেন তাঁরই প্রবীণ ছাত্ররা। মাসটারমশাই চলেছেন ঢ্যাং ঢ্যাং করে। অহঙ্কারহীন মানুষটিকে তখনও কি সরল লাগছিল। 

মাস্টারমশাই চলে গেলেন। একটা পর্ব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এত বছর পরেও মাস্টারমশাইকে মনে আছে। থাকারই কথা। মাস্টারমশাই মানেই তো শিক্ষা আর জীবনের ভিত তৈরির ব্যাপার ছিল। এখন খুবই অবাক করা সময়। শিক্ষায় দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁচ্ছেছে যে, দুঃখ ছাড়া কিছুই পাওয়ার নেই। এখন যে ভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। যেভাবে শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতি এসেছে। তাঁদের কি পরবর্তী প্রজন্ম মনে রাখবে? সেই সব মাস্টারমশাই কি পাওয়া যাবে যাঁরা নিজেকে নিঙড়ে দিয়ে ছাত্রকে মানুষ করে গেছেন।

যে শিক্ষকের নিজেরই ভিত নেই যাঁরা শিক্ষকতার চাকরি নিতে গিয়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে শিক্ষক হয়ে বসেন টাকার জোরে। তাঁরা কি শিক্ষা দেবেন, শিক্ষার মূল্যই বা কি বুঝবেন?

তাই এই সময়ে বারে বারে সেই সব শিক্ষকদেরই মনে পড়ে, যাঁরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। যাঁরা নিজের শিক্ষাটুকু উজাড় করে দিয়ে গেছেন।

আজও তাই সেই সব মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।

অলঙ্করণ: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment