শেয়ারে ধস রাজ্যে আদানি গোষ্ঠীর বিনিয়োগের সম্ভাবনায় আশঙ্কা তৈরি করেছে। আদানিদের হাল কী দাঁড়ায় তার উপর রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি’র বোঝাপড়ার গতিপ্রকৃতিও অনেকটা নির্ভর করবে বলে দুই দলেরই নেতারা মনে করছেন।
রাজ্যে আদানি গোষ্ঠী দুটি প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। সেই দুটি প্রকল্পে তাদের টেন্ডারকে বেছে নিয়েছে রাজ্য সরকার। দুটি প্রকল্পই পূর্ব মেদিনীপুরে। একটি হলদিয়ায়। অপরটি তাজপুরে। তবে দুটির কোনটিরই এখনও কাজ শুরু হয়নি। এছাড়া কয়েক লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করে, পরিবেশের পক্ষে মারাত্মক দেউচা পাঁচামীর খোলা মুখ কয়লা খনির প্রকল্পও আদানিদের ভেট দিতে চায় তৃণমূল সরকার— এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রশাসনিক সূত্রে।
শেয়ারে ধস কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, তা নিয়ে আশঙ্কায় আছে তৃণমূল। রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির বিনিয়োগ ঘোষণা যে ধাক্কা খেতেই পারে তা বোঝা যায় অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মন্তব্যে। শনিবার এই সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছেন,‘‘এই ধসটি খুব তাৎক্ষণিক একটি প্রতিক্রিয়া। আদানিদের সম্পর্কে এই যে রিপোর্টটি বেরিয়েছে তা কিন্তু আস্তে আস্তে জানা যাবে। কিন্তু যদি প্রমাণিত হয় যে আদানিরা কোনও গন্ডগোল করেছেন, তাহলে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশেই সমস্যা দেখা দেবে।’’
অর্থাৎ মোদী, মমতা ব্যানার্জি— দু’জনের শাসনই সমস্যায় পড়তে পারেন। নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ পছন্দের শিল্পপতি আদানিরা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়ে আদানিদের হাজির করতে বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আদানিকে খুশি করার পিছনে তৃণমূল-বিজেপি’র রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অনেকটাই ভূমিকা আছে। এই সময়কালে দুর্নীতির তদন্তগুলিও অনেক বিলম্বিত হয়েছে। ‘অমিত শাহ’র আস্ফালন’ আদানির প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই গায়েব হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-মমতা ব্যানার্জির ‘বাক্যুদ্ধ’ অনেক কমে গেছে। সেখানে আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং তার ফলে তাদের ধস এই ‘সেটিং’য়ে প্রভাব ফেলবে কিনা, তা নিয়ে তৃণমূলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাজ্যে আদানি গোষ্ঠীর হাতে যাওয়া একটি প্রকল্প হলদিয়া বন্দরের দু’নম্বর বার্থ মেকানাইজেশন। এই বার্থের স্বয়ংক্রিয় পরিকাঠামো গড়তে তারা ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে আদানিরা ঘোষণা করেছে। এই সংক্রান্ত ‘কনশেসন অব এগ্রিমেন্ট’ যথেষ্ট গড়িমসির পর সই হয়েছে গত ১৫ সেপ্টেম্বর। যদিও তার ১১ মাস আগে, ২০২১-র ১ অক্টোবর এই সংক্রান্ত টেন্ডার বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ১১ মাসের টালবাহানার পর চুক্তি হয় গত সেপ্টেম্বরে। চুক্তি অনুসারে বার্থের আধুনিকীকরণের পর তা ব্যবহার করবে আদানি গোষ্ঠী।
রাজ্যে আদানি গোষ্ঠী টেন্ডার পেয়েছে কাঁথির কাছে তাজপুর সমুদ্র বন্দরের। এই প্রকল্পে দু’বার দরপত্র দেওয়া হয়েছিল। একবার ২০২১-র অক্টোবরে। দ্বিতীয়বার ২০২২-র ফেব্রুয়ারিতে। প্রথমবার কোনও শিল্পপতি আগ্রহ দেখাননি। দ্বিতীয়বারের দরপত্র ছিল আগেরটিই নয়— কিছুটা সংশোধিত। দ্বিতীয়বার দরপত্রে সাড়া দিয়েছিল দুটি সংস্থা। একটি জেএসডব্লিউ ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। অর্থাৎ সজ্জন জিন্দালের সংস্থা। দ্বিতীয়টি আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড। জেএসডব্লিউ জানিয়েছিল তারা .২৩ হারে কর দেবে রাজ্যকে। আদানিদের দরপত্রে সেই হার ছিল সামান্য বেশি — .২৫।
তবে হলদিয়া কিংবা তাজপুর — কোনও প্রকল্পেই এখনও কাজ শুরু হয়নি।
মোদীর পছন্দের ব্যবসায়ীকে সুবিধা করে দিতে মমতা ব্যানার্জির সরকার কতটা মরিয়া, তার কিছুটা প্রমাণ তাজপুর প্রকল্প। রাজ্য সরকারের যে চুক্তিপত্রের ভিত্তিতে তাজপুরে বন্দর তৈরির দরপত্র জমা দিয়েছে আদানিরা, সেই ২৫৬ পাতার ‘ড্রাফট কনসেসান এগ্রিমেন্ট’-এ কর্মসংস্থান সম্পর্কে মাত্র দুটি অনুচ্ছেদ আছে — ৫.৬ এবং ৫.৭। কোন ধারাতেই স্থানীয়দের প্রশিক্ষিত করে নিয়োগের কথা নেই। তাজপুরে ১১২৬ একর জমি রাজ্য সরকার দিয়েছে ১ টাকা লিজে। পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগম সূত্রে জানা গেছে, প্রথম যখন এই প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল ২০১৮-তে, তখন নিগমের পক্ষ থেকে ৩৫ বছরের লিজের শর্ত রাখা ছিল ‘ড্রাফট কনসেসান এগ্রিমেন্ট’-এ। এখন তা করা হয়েছে ৯৯ বছরের। চুক্তিপত্রের ৪.১.২(জি) ধারা জানাচ্ছে এই প্রকল্পে কোনও স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন চার্জ দিতে হবে না। এর বাইরে জমি লাগলে সরকার একই হারে তার ব্যবস্থা করবে। আদানিদের পাওয়ার জন্য চুক্তিতে বদল হয়েছে কিছু। যেমন প্রথম ডিসিএ-তে ২৬.৫.২ বলে একটি অনুচ্ছেদ ছিল। যেখানে লেখা হয়েছিল যে, যদি দেখা যায় যত মাল ওঠানামা করছে, তা যা সরকারকে জানানো হয়েছে তার থেকে বেশি, তাহলে যত বেশি মাল ওঠানামা করছে তাকে ১৮০ দিয়ে গুণ করা হবে। সেই অঙ্কটির অনুপাতে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নেওয়া হবে। দ্বিতীয় ডিসিএ-তে এই অংশটি উধাও। বাদ পড়েছে। তার বদলে লেখা হয়েছে ‘অথরিটি’ (মানে সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান) যে কোনও সময়ে বন্দরে মাল ওঠানামা হিসাব সংক্রান্ত কাগজপত্র চাইতে পারে। দেখতে পারে। কিন্তু টাকা দেওয়ার কথা উহ্য।
এমন আরও আছে। এই সবই করা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর পছন্দের সংস্থার স্বার্থে।
এবার কী হয়? আদানিদের শেয়ার-কাণ্ড সেই প্রশ্ন তুলছে।
Mamata Asani investment
রাজ্যে মমতা আদানি সমঝোতা শঙ্কার মুখে
×
Comments :0