Salim on Netaji birthday

ব্রিটিশের তাঁবেদাররা নেতাজীপ্রীতি দেখাচ্ছে

কলকাতা

মমতা ব্যানার্জি সঙ্ঘকে ছুঁলেন না রেড রোডে। মোহন ভাগবতও রাজ্যের দুর্নীতি, লুটতরাজ, অপশাসনের ধারকাছ দিয়ে গেলেন না শহীদ মিনারের পাশের মাঠে। 
রাজনীতির ধারে কাছ দিয়ে গেলেন না আরএসএস-র প্রধান। কিন্তু রাজনীতিই করে গেলেন তিনি।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে সোমবার শহীদ মিনার সংলগ্ন মাঠে ভাষণ দিয়েছেন সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক তথা প্রধান। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নেতাজী লহ প্রণাম।’ সেই অনুষ্ঠানে সঙ্ঘের কর্মীদের কুচকাওয়াজের পর ভাষণ দেন মোহন ভাগবত। সঙ্ঘের সভার অনুমতি দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু রেড রোডের অনুষ্ঠানে নেতাজীর মতো ধর্মনিরপেক্ষ নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সঙ্ঘের ব্যবহারের কৌশল সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি মমতা ব্যানার্জি। তিনি সেই একই সুরে সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের। ‘দিদির দূত’রা মানুষের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন ইদানীং। নেতাজী-স্মরণের মঞ্চে সেই ‘দূত’দের দুর্দশা আড়াল করতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন,‘‘রাস্তা দিয়ে গেলে মানুষ কিছু বলবে না, তা নয়। ক্ষোভ থাকতেই পারে। মানুষের কিছু জানানোকে বিক্ষোভ বলে না।”
ভাগবত সোমবার বলেছেন, “আমরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন হয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমরা আমাদের ঐতিহাসিকতা এবং আমাদের মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে স্বতন্ত্রতার দিকে আজও এগিয়ে যেতে পারিনি। এটাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর স্বপ্ন ছিল।”
শহীদ মিনার ময়দানে সঙ্ঘের এই সভার প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন,‘‘দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের স্মৃতি ফলকের সামনে বিজেপি আরএসএসের সভা! দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকা নেয়নি তারা, উপরন্তু ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করেছে। আরএসএসের এমন একজন শহীদের নামও করতে পারবেন না, যারা দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। সেই তারাই এখন শহীদমিনারে সভা করে নেতাজীপ্রীতি দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।’’ 
স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের মানুষের সামনে নেতাজীর আদর্শ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যের কতটা বিরোধী সঙ্ঘ, তা তুলে ধরার সুযোগ ছিল মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জির। কিন্তু সঙ্ঘের ‘সাক্ষাৎ দুর্গা’ পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলা ‘হিন্দুত্ব’র বিপদ, সঙ্ঘের ভূমিকা নিয়ে একটি কথাও এদিন বলেননি।
সঙ্ঘের ধারণায় ‘স্বতন্ত্রতা’ কী— তা স্পষ্ট করেননি ভাগবত। দেশে বেশিরভাগ সম্পদ যখন নরেন্দ্র মোদীর পছন্দের ব্যবসায়ীদের হাতে জমা হয়েছে, ক্ষুধা তালিকায় ভারত পৃথিবীর প্রথম দিকে যখন, তখন ভাগবত বলেন, “আমরা যখন গৌরবময় ভারত গড়ার কথা বলি, তার মানে এই নয় যে, কেবলমাত্র সম্পদ ও শস্যেই দেশকে সমৃদ্ধ হতে হবে।’’ তাঁর পরামর্শ,‘‘আমাদের এমন একটি গৌরবময় ভারত গড়তে হবে যা সারা বিশ্বে সুখ ও শান্তি আনতে পারে।’’
এই সূত্রে সেলিমের বক্তব্য,‘‘ব্রিটিশরা এদেশে কোম্পানিরাজ এনেছিল। বর্তমান বিজেপি-আরএসএস সরকার দেশে কর্পোরেটরাজ কায়েম করতে চাইছে। ভারতবর্ষের মানুষ সেদিন যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, বর্তমানে কর্পোরেটরাজের বিরুদ্ধেও সমানে লড়ছেন।’’
সঙ্ঘের প্রধান এদিন বলেছেন,‘‘ভারত সারা বিশ্বকে ধর্মের দিশা দেয়। মানুষের অগ্রগতির পাশাপাশি আমরা সমগ্র মহাবিশ্বের কথা ভাবি। এটাই আমাদের অগ্রগতির সংস্কৃতি। সেজন্য আমাদের এমন একটি গৌরবময় ভারত গড়তে হবে যার দিকে সারা বিশ্ব আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।”
সেই গৌরবময় ভারত কেমন? মোহন ভাগবতের কথায়,‘‘নেতাজী বারবার বলতেন যে, রাষ্ট্রীয়তার বিকাশ ছাড়া ব্যক্তিত্ব বিকাশের কোনও অর্থ নেই। রাষ্ট্রীয়তা ছাড়া ব্যক্তিত্বের বিকাশ অসম্পূর্ণ। সমাজের কোনও একটা ছোট অংশের বিকাশ করলেই হবে না, সম্পূর্ণ সমাজের বিকাশ চাই। রাষ্ট্রীয়তার চর্চা ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই পরাধীনতার শুরু।’’
এই ‘রাষ্ট্রীয়তা’ মানে জাতীয়তাবাদ। সঙ্ঘের জাতীয়তাবাদ মানে ‘হিন্দুত্ব।’ এদিন কিন্তু সেই ‘হিন্দুত্ব’-র প্রসঙ্গ সুকৌশলে আড়াল করেছেন মোহন ভাগবত। সামনে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। এই সময়ে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার যে সভায় হাজির সেখানে হিন্দুত্বের কথা সরাসরি বললে ভোটের হিসাবে গোলমাল হতে পারে— এমন আশঙ্কা আছেই। 
ভাগবত বলেছেন,‘‘এদেশে অনেক ভাষা অনেক পন্থা রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই ঐক্য আছে।’’ তবে ভাগবতের কথায়,‘‘সব বিযয়গুলি বজায় রেখে, তার মধ্যে রাষ্ট্রীয়তাকে প্রাধান্য দিতে হবে।’’ অর্থাৎ সঙ্ঘের জাতীয়তাবাদকেই সবার উপরে স্থান দিতে হবে। মোহন ভাগবতের দাবি,‘‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু যে গৌরবময় ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন পূরণে সঙ্ঘ এগিয়ে চলেছে।”
এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এদিন বলেন,‘‘যারা গান্ধীহত্যার জন্য নাথুরামকে দেবতা বানায়, তারাই আবার নেতাজীপ্রীতি দেখাচ্ছে‌?’’ সেলিম অভিযোগ করে বলেছেন, ‘‘আজাদ হিন্দ নাম নিয়েও আরএসএস’র ওজর আপত্তি ছিল। আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের অন্যতম সহযোগী তৃণমূল নিজেদের ইচ্ছামতো ইতিহাস নির্মাণ করতে চাইছে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে দেশের চিরাচরিত ঐতিহ্যকে। সেই স্মৃতি-ঐতিহ্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment