Electoral bonds

কর্পোরেটের হাত মাথায়, নির্বাচনী বন্ডেই আয় ৫২৮ কোটি!

রাজ্য

Electoral bonds

ছবি এঁকে, নিজের বই বিক্রি করে দল চালানোর খরচ তোলা হয়— এমন অদ্ভুত দাবি শোনা গিয়েছিল খোদ তৃণমূল নেত্রীর মুখ থেকেই।
অথচ নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া মমতা ব্যানার্জির দলের অডিট রিপোর্টের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ আর্থিক বছরে তৃণমূলের মোট আয়ের ৯৬ শতাংশ এসেছে কেবলমাত্র নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। একটা রাজনৈতিক দলের ৯৬ শতাংশ আয় স্রেফ নির্বাচনী বন্ড অর্থাৎ কর্পোরেট চাঁদার মাধ্যমে! 
শুধুমাত্র একটি আর্থিক বছরে ৫২৮ কোটি ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা তৃণমূলের কোষাগারে ঢুকেছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে

গত ৩ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের তরফে অরূপ বিশ্বাস ও চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সই করা অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তৃণমূল। অডিট রিপোর্টে দেখানো হয়েছে গত বছরে তৃণমূলের মোট আয়ের পরিমাণ ৫৪৫ কোটি ৭৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৪৯১ টাকা! একই আর্থিক বছরে কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় বড় রাজনৈতিক দলের আয় সেখানে ৭৫ কোটি ৮৪ লক্ষ ৩১ হাজার ১১৭ টাকা! অর্থাৎ ২০২২ সালের কংগ্রেসের থেকেও সাতগুণ আয় বেশি করেছে তৃণমূল।

তৃণমূলের মোট আয়ের পরিমাণ ৫৪৫ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে শুধুমাত্র নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেটের চাঁদা তৃণমূলের তহবিলে ঢুকেছে ৫২৮ কোটি ৫২ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। মোট আয়ের যা ৯৬ শতাংশ। বাকি মাত্র চার শতাংশ হলো দলের সাংসদ, বিধায়কদের থেকে চাঁদা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান। একই সময়কালে কংগ্রেসে কোষাগারে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা ঢুকেছে মাত্র ১৪ কোটি!


আবার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ২০২০-২১ আর্থিক বছর অর্থাৎ বিধানসভা ভোটের বছরের আয়ের তুলনায় ২১-২২’র সালে তৃণমূলের আয় বেড়েছে ৭৩৬ শতাংশ!
গত আর্থিক বছরে অর্থাৎ ভোটের বছরে তৃণমূলের মোট আয় দেখানো হয়েছিল ৭৪ কোটি ৪১ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪৭২ টাকা। ভোটে ফের জয়ী হয়ে তৃতীয়বার সরকার গড়লেন মমতা ব্যানার্জি। ততদিনে গোরু, কয়লা পাচারের তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনে আসতে শুরু করে কোটি কোটি টাকার পাচারের তথ্য। একইসঙ্গে দেখা যায় কলকাতা শহর সহ একাধিক জেলায় হুহু করে বাড়তে শুরু করে শিখণ্ডী সংস্থার সংখ্যা। ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমেই টাকা পাচারের নেটওয়ার্ক। আর ঠিক সেই সময়তেই ২০২১-২২ আর্থিক বছরে তৃণমূলের আয় ৭৩৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ালো ৫৪৫ কোটির বেশি! 
বিধানসভা ভোটের বছরে নির্বাচনী বন্ডের তৃণমূলের কোষাগারে ঢুকেছিল ৪২ কোটি টাকা। তারপরের বছরেই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তৃণমূলের কোষাগারে ঢুকল ৫২৮ কোটির বেশি! অর্থাৎ এক বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তৃণমূলের আয় রীতিমতো জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বেড়ে গেলে ১২০০ শতাংশ!

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে এখনও পর্যন্ত পাঁচটি রাজনৈতিক দলের অডিট রিপোর্ট তোলা হয়েছে। বিজপি’র অডিট রিপোর্টের হিসাব এখনও ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস, সিপিআই(এম), বিএসপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ও তৃণমূলের অডিট রিপোর্ট ভারতের নির্বাচন কমিশন আপলোড করেছে। তাতে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আয়ে প্রথম মমতা ব্যানার্জির দলই। 
আর সিপিআই(এম)? ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে সিপিআই(এম) প্রথম থেকেই এভাবে রাজনৈতিক দলকে গোপনে বিপুল অঙ্কের টাকা চাঁদা দেওয়ার এই স্কিম তীব্র বিরোধিতা জানিয়ে আসছে। সিপিআই(এম) মনে করে নির্বাচনী তহবিলের অস্বচ্ছতাকেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। ফলে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সিপিআই(এম)-র তহবিলে ঢোকার অর্থের পরিমাণ শূন্য, নীতিগত ভাবেই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয় না। অডিট রিপোর্টের তথ্য বলছে সিপিআই(এম)র আয়ের  ২৯শতাংশ হলো দলের সদস্যদের প্রতি মাসে দেওয়া লেভির টাকা, ৪০ শতাংশ হলো স্বেচ্ছা অনুদান! নির্বাচনী বন্ড থেকে একটি টাকাও নয়। সিপিআই(এম)-র থেকে তৃণমূলের আয় তিন গুণেরও বেশি।

বৃহৎ কর্পোরেটের স্বাভাবিক পছন্দ উগ্র দক্ষিণপন্থী দল হিসাবে বিজেপি। তথ্য জানার অধিকার আইনেই দেখা গিয়েছে বন্ডে কর্পোরেট চাঁদার সিংহভাগ যায় বিজেপি’র কোষাগারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে দায়ের করা রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ অডিট রিপোর্টের হিসাব বলছে এদেশের বৃহৎ কর্পোরেটের পছন্দের দল হিসাবে বিজেপি’কে সমান সমান টক্কর দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। এটা রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা। যে বৃহৎ কর্পোরেট অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি প্রথম পছন্দের মনে করছে তারা একইভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা গোপনে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তৃণমূলের পিছনে ঢালছে!

আবার নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমেও তোলাবাজিকে কীভাবে বৈধতা দেওয়া যায় তারও প্রমাণ মিলেছে খাস লকডাউনের সময়ে, এরাজ্যেই। 
করোনার সময়ে ২০২০ সালের জুনে অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্রের ডায়মন্ডহারবার-২ নম্বর ব্লকের আইএফবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় তোলা চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, তলোয়ার নিয়ে কারখানায় ঢুকে নির্বিচারে ভাঙচুর, হামলা চালায় তৃণমূলের বাহিনী। জানা গিয়েছিল, বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা তোলা দাবি করা হয়েছিল। আইএফবি’র প্ল্যান্টে ২৫ কোটি বোতল মদ তৈরি হয় প্রতি বছর। প্রতি বোতলে দুই টাকা হিসাবে মোট ৫০ কোটি।


এই ঘটনার পরে ২০২০ সালের ২৬ জুন এবং ২২ ডিসেম্বর পরপর দু’বার স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি লিখে আইএফবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে জানায় যে তাদের ওই নূরপুর ইউনিটে ১৫০ জনের সশস্ত্র বাহিনী কারখানায় হামলা, ভাঙচুর চালিয়েছিল। শুধু তাই নয় মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীকেও জানিয়েও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। এরপরেই ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর আইএফবি অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ বোর্ড অব ডিরেক্টর্স’র মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হবে। তাতেও পরিস্থিতি ‘মসৃণ’ না হওয়ায় ফের সেই সংস্থা স্টক এক্সচেঞ্জে চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, ব্যবসার পথ মসৃণ রাখতে সংস্থার পরিচালন পর্ষদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে তাঁরা রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেবে।

অর্থাৎ তোলাবাজির সরাসরি টাকা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমেই ঢুকে পড়ল শাসকের তহবিলে। গোরু পাচার, কয়লা পাচারের টাকাও শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে কী তবে ঢুকেছে বৃহৎ কর্পোরেটের অন্যতম পছন্দের দলে পরিণত হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসে? 
২০২০ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্র। বিধি অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিক এমন যে কেউ এবং ভারতের কোনও সংস্থা এই বন্ড কিনতে পারবে। একমাত্র নথিভুক্ত রাজনৈতিক দল, যাদের গত লোকসভা কিংবা বিধানসভা নির্বাচনে সমর্থনের হার ১ শতাংশের উপর, তারা এই বন্ড পাওয়ার যোগ্য থাকবে। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ এবং ১ কোটির বন্ড পাওয়া যায়। প্রতি ত্রৈমাসিকে দশদিনের জন্য এই বন্ড খোলা হয়। আর নির্বাচন সামনে থাকলে এই মেয়াদ থাকবে ১৫দিন। এতে কোনও কর্পোরেট কাকে চাঁদা দিচ্ছে তা গোপন রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সময়তেই তথ্য জানার অধিকার আইনে দেখা গেছে বন্ডে কর্পোরেট চাঁদার সিংহভাগ গেছে বিজেপি’র তহবিলে।


আর গত বছরের পাওয়া হিসাব বলছে কর্পোরেটে চাঁদার শতাংশের বিচারে ভারতে অন্য সব রাজনৈতিক দলকে কার্যত পিছনে ফেলে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির ‘মা মাটি মানুষের’ দল তৃণমূল কংগ্রেস।

 

Comments :0

Login to leave a comment