শাশ্বত ব্যানার্জি-ফিলাডেলফিয়া
‘‘ভোটে যিনি জিতুন, তাঁর লাগাম থাকবে ধনীদের হাতেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত এদেশে এই দুই দলের একচেটিয়া খতম না হচ্ছে, আমাদের মতো খেটেখাওয়া মানুষের হাতে সরকারের লাগাম আসবে না,’’ জীবনের ‘শেষ’ ভোট দিতে যাওয়ার সময় এমনটাই বললেন ড্যানিয়েল রজার্স। পেনসিলভেনিয়ার বাসিন্দা এই অশীতিপর বৃদ্ধ ফুসফুসে ক্যানসার নিয়ে অন্তিম দিন গুনছেন। দুই নাতি নাতনির সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন ভোটকেন্দ্রে। পেশায় ইস্পাত কারখানার শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক, ড্যানিয়েল গত পনেরো বছর আগে অবসর নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার ফলে বছর পাঁচেক আগে ফুসফুসে ক্যানসার বাসা বাঁধে। ন্যায্য মূল্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ না পেয়ে কার্যত বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুর দিন গুনছেন তিনি।
প্রধান ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড স্টেট’ হিসাবে পরিচিত পেনসিলভেনিয়া, প্রতিবারই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথা বলে। প্রচার শেষের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দুই প্রধান প্রার্থীই এই প্রদেশে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। মঙ্গলবারের আগেই পেনসিলভেনিয়ায় আগাম ভোট দিয়ে ফেলেন প্রায় সাড়ে সতেরো লক্ষ মানুষ। ফিলাডেলফিয়ায় এদিন সকাল থেকে বেশ উত্তেজনা চোখে পড়লেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ফলপ্রকাশের পর চিত্রটা বেশ স্পষ্ট হয়ে গেল। ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে ‘ক্ষমতা ফিরে পাওয়া’র চওড়া হাসি। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ‘গেল গেল’ রব। অনেকে আবার উত্তেজনার বশে ভোট ব্যবস্থাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছেন। আবার একটা বড় অংশের মধ্যে কোনও তাপউত্তাপ চোখে পড়ছে না। ‘‘একবার তো দেখেইছি, আরও একবার দেখব খন,’’ এমনই শোনা গেল পথচলতি কিছু মানুষের মুখে।
নভেম্বরের শুরুতেই এখানে কনকনে ঠান্ডা পড়েছে। জ্যাকেট-কোট গায়ে ভোরবেলা থেকেই ভোটকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছেন শহরের ভোটকেন্দ্রগুলিতে। শহরাঞ্চলে সকাল থেকেই বৃদ্ধ, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী ভোটারদের সাহায্য করতে সক্রিয়তা দেখা গিয়েছে। শহরের কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন আমেরিকা বংশোদ্ভূত ভোটাররা ডেমোক্র্যাটদের মূল ভরসার জায়গা। তাঁদের অধিকাংশের কাছেই এবার ভোটের মূল ইস্যু ছিল— ন্যায্য মূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্কুল শিক্ষা পরিকাঠামোয় বৃদ্ধি ও বাসস্থান সঙ্কট। এদিকে তিন শিশুকন্যার মা অ্যাভা ব্রুক্স একটা ছোট দোকান চালান। ভোটের লাইনে উনি বললেন, ‘‘নিতান্ত অসহায় হয়েই কমলাকে ভোট দেব। দিতে যে খুব একটা ইচ্ছে আছে এমনটা নয়। তবে ট্রাম্প সরাসরি একচেটিয়া কারবারিদের পক্ষে। আমাদের মতো যাঁরা ছোটখাট দোকানপাট চালান তাঁদের যদি উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়, তাতে ওঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।’’
অন্যবারের তুলনায় পেনসিলভেনিয়ার শিল্পপ্রধান শহরতলি পিটসবার্গে ‘ইলেকশন ডে’-র সকালে অনেকটাই বেশি উৎসাহ চোখে পড়ল। গত কয়েক বছর মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে ভোট দেওয়ার হিড়িক অনেকটাই বেড়েছে। গত বারের ভোটের সময় কোভিড নিয়মবিধি লাগু থাকায়, দৃশ্যত এত উৎসাহ দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আগে যেখানে শুধু মাঝবয়সি বা বৃদ্ধদেরই ভোট দেওয়ার লাইনে দেখা যেত। অবশ্য ২০২০ সাল থেকে তরুণদের মধ্যেও ভোট দেওয়ার প্রবণতা বেশ খানিকটা বেড়েছে। আমার ‘ফ্ল্যাট মেট’, পেশায় ডেলিভারি কর্মী, বত্রিশ বছর বয়সি নিক লং-কে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, ‘‘বুঝতেই পারছো। আগে যে আসতো, তাতে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন তেমন বদলাতো না। তাই ভোট দেওয়ার বিষয়ে কারোর তেমন উৎসাহ ছিল না। গত ২০১৬ থেকে এটা পালটেছে।’’
সকাল থেকেই পিটসবার্গের ভোটকেন্দ্রে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিকাংশই খেটেখাওয়া মানুষ। দেশে চলতি মন্দায় অনেকেই তার মধ্যে অসন্তুষ্ট। গত বারের ভোটে বাইডেন জিতলেও এবারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলল একাংশের থেকে। ভোট দিতে আসা মাঝবয়সি কারখানা শ্রমিকদের একদলের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, কল-কারখানার বেহাল দশা, ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা এবং মন্দার পরিস্থিতিতে ডেমোক্র্যাটদের মোটেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন না। কয়েকজনের মুখে ট্রাম্পের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন দেখা গেলেও অধিকাংশই দোটানায় ভুগছেন।
তবে শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা তরুণ, তাঁদের বক্তব্য ভিন্ন। অনেকেই ট্রাম্পের শ্রমিক বিরোধী, অভিবাসন বিরোধী, গর্ভপাত বিরোধী ভাষ্যে বেশ ক্ষুব্ধ। শিল্প প্রধান পিটসবার্গ অঞ্চলে, তরুণ ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের একাংশ বলছেন, ‘‘ট্রাম্পের আমলে মালিকপক্ষের ক্ষমতা বেড়েছে। ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য উনি অনেক রকম চেষ্টা করেছেন।’’ উলটোদিকে তাদের অনেকেই আবার চলতি বেকারি ও ছাঁটাই নিয়ে সরকার কোনও ভূমিকা না রাখায় ক্ষুব্ধ।
শহরাঞ্চলের সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনও একটি মূল বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে। স্ক্র্যান্টন শহরের এক ভোটকেন্দ্রের বাইরে, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকার দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দেখা গেল হাইস্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের একাংশকে। তাদেরই সঙ্গে পা মিলিয়েছেন কয়েকজন বৃদ্ধ ও প্রৌঢ়। পথচলতি কিছু মানুষের মুখে তাঁদের প্রতি সমর্থনও চোখে পড়ল। ভোট দিয়ে ফেরার পথে নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী জ্যাকব টার্নার বলেন, ‘‘পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে এগচ্ছে। বুক ভরা শ্বাসটুকু নেওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে, এই দাবিকে সমর্থন না করে থাকা যায়। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্ন।’’
দুপুর পর্যন্ত পেনসিলভানিয়ার সব কটি কেন্দ্রেই রেকর্ড ভোট পড়েছে। ফিলাডেলফিয়া, পিটসবার্গ বা স্ক্র্যান্টনের মতো বড় শহরগুলির থেকে পিছিয়ে নেই ছোট শহর, গ্রাম-মফস্বলেও। রিপাবলিকানদের মূল ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত এই অঞ্চলগুলিতে শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীল পরিবারের ঘনত্ব বেশি। তবুও মূল ইস্যু এখানেও অর্থনীতি। পরপর কোভিড সঙ্কট ও অর্থনৈতিক মন্দায় মার্কিন ভোটারদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অংশের কাছে নির্বাচনের মূল ইস্যু আর অভিবাসন বা বিদেশনীতি নয়। বরং তা হয়েছে রুটিরুজির সমস্যা, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা।
অ্যালেনটাউনের বাসিন্দা মারিয়া লোপেজ স্থানীয় এক সমাজকর্মী। ভোটের ইস্যুতে বদলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘এমন পরিবর্তন বেশ ইতিবাচক বলেই আমি মনে করছি। আমাদের কাছে ভোট ব্যবস্থা যদি শুধু প্রার্থী পালটানোর মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় তবে এই ব্যবস্থা তার গণতান্ত্রিকতা হারাবে। বরং নির্বাচন ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিনের দাবিদাওয়া বাস্তবায়িত করার মাধ্যম হিসাবে দেখতে হবে। এমনটা তখনই হবে যদি মানুষ হুজুগের বশে না পড়ে, তার নিজের চাহিদা ও দাবির ভিত্তিতে ভোট দেয়।’’
Comments :0