Primary Students

ভয়াবহ মাত্রায় স্কুলছুট, তথ্য সরকারি সমীক্ষাতেই

রাজ্য

মাত্র ১০ শতাংশ সার্কেল (চক্র) ধরে প্রাথমিকে স্কুলছুটের নমুনা সমীক্ষায় নামানো হয়েছিল। তাতেই দেখা গেছে, কোভিড পরবর্তী সময়ে ২৫ হাজারের ওপর প্রাথমিক পড়ুয়া ছিটকে গেছে শিক্ষার আঙিনা থেকে। 
চলতি মাসের শুরুতে রাজ্যের ২৪ টি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের ৭২টি সার্কেল এলাকাজুড়ে স্কুলছুট পড়ুয়াদের তথ্য তালাশ করতে নমুনা সমীক্ষা করা হয়েছিল। ‘পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন’-এর উদ্যোগে চলতি মাসের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ছয় দিন ধরে সমীক্ষায় অংশ নেন সমীক্ষক দল। তাদের রিপোর্টেই উঠে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষায় ভয়াবহ স্কুলছুটের চিত্র। 
শুধু এক শিক্ষাবর্ষেই মাধ্যমিকে ৪০শতাংশ পরীক্ষার্থী কমে গেছে। শিক্ষার শুরুর ধাপেই নমুনা সমীক্ষায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে ‘ড্রপ আউট’-এর শিউরে ওঠা ছবি। নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া সরকারের এখন শিক্ষার অধিকার নিয়ে ভাববার সময় নেই। 
শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৪টি জেলার ৭৪টি সার্কেল এলাকা থেকে নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেছে ২৫ হাজার ৬৪৬ জন প্রাথমিক পড়ুয়া কোভিড পরবর্তী সময়ে আর স্কুলে ফিরে আসেনি। রাজ্যে এই মহূর্তে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় ৭২৫টি সার্কেল আছে। তার মধ্যে ৭৪টি সার্কেলে নমুনা সমীক্ষা চালিয়ে স্কুলছুটের এই ছবি দেখে রীতিমতো উদ্বিগ্ন রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকরা। নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তার সত্যতা যাচাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল জেলাস্তরের প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের। তথ্য যাচাই করতে গিয়েও স্কুলছুটের সংখ্যার কার্যত কোনও হেরফের হয়নি। 
নমুন সমীক্ষায় স্কুলছুটের তালিকায় শীর্ষে আছে মুর্শিদাবাদ জেলার ধূলিয়ান সার্কেল। প্রায় ১৩০০-র ওপর প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়া কোভিড পরবর্তী সময়ে স্কুলে আর ফিরে আসেনি। একই অবস্থা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ক্যানিং সার্কেলে। ৭০০ প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়ার হদিশ নেই বিদ্যালয়ে। এরপরই আছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মিনাখাঁ সার্কেল। ৬৮০জন প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়া ফিরে আসেনি বিদ্যালয়ে। যে ৭৪টি সার্কেলজুড়ে নমুনা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তার কোথাও স্কুলছুট নেই, এমন ছাত্র-ছাত্রী খুঁজে পায়নি সমীক্ষক দল। 
কী কারণে শিশুরা স্কুলের আওতা থেকে চলে যাচ্ছে? রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ কোভিড অতিমারী স্কুলছুট হওয়ার সবথেকে বড় কারণ। এলাকায় খোঁজ করতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে,যে শিশুদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। তার কারণ, কাজের তীব্র সঙ্কটে পড়ে সন্তানদের নিয়ে বাবা, মা ভিনরাজ্যে চলে গেছে।’’ এছাড়াও যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তি করে দেওয়ার কথাও বলছেন শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা। 
শিক্ষা দপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে, কোভিড অতিমারী আসার আগে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এরাজ্যে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ লক্ষ। সেই সংখ্যা এখন প্রায় ৭২লক্ষে নেমে গেছে। ফলে সোজা হিসাবেই রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৮লক্ষের ওপর ছাত্র-ছাত্রী উধাও হয়ে গেছে। এরাজ্যে ৫৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। ছাত্র সঙ্কটে পড়ে কোভিড পরবর্তী সময়ে প্রায় ২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি মাস থেকে নতুন পাঠক্রম শুরু হয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে চলতি বছরে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কতজন ছাত্র-ছাত্রী নথিভুক্ত হয়েছে। 
নমুনা সমীক্ষার এই ভয়াবহ চিত্র সামনে আসার পর শিক্ষা দপ্তরের প্রধান সচিব মনীশ জৈন দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু কীভাবে এই সমস্যার সামাধান করে ফের স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার আঙিনায় ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে কোনও পরিকল্পনা করা হয়নি। বরং গোটা দায় জেলাস্তরের আধিকারিকদের ওপর চাপিয়ে দায় সেরেছেন দপ্তরের প্রধান সচিব। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে আধিকারিকদের উদ্দেশ্যে প্রধান সচিব বলেন, ‘‘ঘুমিয়ে আছেন? রিটায়ার করেছেন? সরকারের টাকা নেন। কাজ করেন না। লজ্জা করে না?’’ আসলে নিয়োগ দুর্নীতিতে শিক্ষা দপ্তর যেভাবে জড়িয়ে গেছে, তাতে স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের কীভাবে ফের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় নেই। ‘‘নমুনা সমীক্ষায় পর সরকারের টনক নড়েনি। ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে ফেরানো নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দেশিকা সরকার সামনে আনতে পারেনি। আসলে বিকাশ ভবন এখন দুর্নীতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত।’’ অভিযোগ এক আধিকারিকের।
প্রাথমিক শিক্ষায় স্কুলছুটের এই ভয়াবহতা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি মোহনদাস পণ্ডিতের বক্তব্য,‘‘ যারা একবার স্কুলের আঙিনা থেকে বেরিয়ে যায়, তাদের ফেরানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তার জন্য দরকার সরকারের সদর্থক ভূমিকা। স্কুলছুটদের ফেরাতে হলো নিতে হবে উৎসাহ প্রদানকারী কর্মসূচি। কিন্তু সরকারের এসবের দিকে কোনও নজর নেই।’’

Comments :0

Login to leave a comment