ROMILA THAPAR SPEECH

ধর্মীয় দৃষ্টিতে ইতিহাস চর্চা হতে পারে না

জাতীয়

Romila thapar history indian history far right

প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস হয় না, বললেন দেশের বিশিষ্ট ও প্রবীণ ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। তাঁর স্পষ্ট অভিমত, ধর্মের ভিত্তিতে কাঠগড়ায় তোলার লক্ষ্য নিয়ে নয়, ইতিহাস চর্চা করতে হবে পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রমাণের ভিত্তিতে। শনিবার নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে ‘আমাদের ইতিহাস, তোমাদের ইতিহাস, কাদের ইতিহাস?’ শীর্ষক আলোচনাসভায় তিনি বক্তব্য রাখছিলেন। ভারতে যখন আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী শক্তি কিছু ধর্মীয় বিশ্বাসকে ইতিহাস বলে প্রচার করে চলেছে, পৌরাণিক কল্পকাহিনীকে ইতিহাস বলে দাবি করে চলেছে এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে উসকানি দিচ্ছে, তখন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর রোমিলা থাপারের এই মন্তব্য নিশ্চিতভাবেই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।


শুধু কল্পকাহিনীকে ইতিহাস বলে চালানো নয়, বাস্তবে আরএসএস’র নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদীরা এদেশে বহু বছর ধরেই সংখ্যাগুরুবাদী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করে চলেছে। যেমন, হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার, দিল্লির কুতুব মিনার তৈরি করা হয়েছে একটি মন্দির ভেঙে এবং আসলে সেটি ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’। কুতুব মিনারের গায়ে রয়েছে সংস্কৃততে কিছু লেখা, রয়েছে বিশ্বকর্মার মূর্তির প্রতিরূপ। তাকেই হিন্দুত্ববাদীরা ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’র প্রমাণ বলে দাবি করে। ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের ভাষণে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ রোমিলা থাপার ইতিহাসের সেই বিকৃতির প্রমাণ দিয়েছেন। 

তিনি বলেছেন, চতুর্দশ শতাব্দীতে বজ্রপাতে বড় ক্ষতি হয়েছিল কুতুব মিনা‍‌রের। যে রাজমিস্ত্রিরা তখন সৌধটি মেরামতের কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন লক্ষ্মণ, নানা, সোলহা প্রমুখ। তাঁরা সবাই ছিলেন হিন্দু। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন স্থপতি চাহাদা দেবপালা, তিনিও ছিলেন হিন্দু। মেরামতির সময়ে তাঁরা সৌধটির নানা জায়গায় হিন্দিতে ও ভুল সংস্কৃততে নিজেদের নাম এবং নিজেদের দেবতা বিশ্বকর্মার প্রতিরূপ খোদাই করে দেন। থাপার বলেন, না ওই রাজমিস্ত্রিদের দিয়ে জোর করে খাটানো হয়েছিল, না তাঁদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। তাহলে তাঁরা নিজেদের দেবতার প্রতিমূর্তি খোদাই করতে পারতেন না সৌধের দেওয়ালে।

 
থাপার ভাষণে জোর দিয়েছেন ইতিহাসের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যায়। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, আজকের দিনে ধর্মীয় পরিচিতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কীভাবে ইতিহাসের ব্যবহার হচ্ছে। থাপার ভাষণ শুরুই করেছেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবামের এক উদ্ধৃতি দিয়ে। 

হবসবাম বলেছিলেন, হেরোইনে আসক্ত এক জনের কাছে আফিম যা, জাতীয়তাবাদের কাছে ইতিহাস তা। তা উল্লেখ করে থাপার বলেন, হেরোইন-আসক্ত যখন আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে যান, তখন তিনি উজ্জ্বল অতীতের কল্পনায় ভাসতে থাকেন এবং বর্তমান নিয়েও তার নিরিখে ভাবতে থাকেন। আজকের দিনে জাতীয়তাবাদ ইতিহাসকে সেভাবেই ব্যবহার করছে।

 প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতার জন্য লড়াই‍‍‌য়ের সময়ে এমন দেশ গঠনের লক্ষ্য থাকে জাতীয়তাবাদের, যেখানে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হবেন নাগরিকরা। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনে সেই একক লক্ষ্যের জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটার পাশাপাশি ধর্মীয় পরিচিতিভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদও আত্মপ্রকাশ করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল এই বিভাজিত জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। আজ প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে এর সংযোগসূত্র দাবি করে একে বৈধতা দিতে চাওয়া হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসনের পর্বে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে জোর দিয়েছিল।

 অন্যদিকে, দুই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দেশকে ভাগ করেছিল হিন্দু-মুসলিমে। আরও পিছনের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যাবে, তখনও এ‍‌ই বিভাজিত জাতীয়তাবাদ ছিল না। মুঘল অর্থনীতির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল রাজা তোদর মলের বিশ্বস্ত হাতে। হলদিঘাটির যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজা মান সিং, যিনি ছিলেন রাজপুত। তিনি পরাস্ত করেছিলেন আরেক রাজপুত মহারানা প্রতাপকে। আবার মহারানা প্রতাপের সেনাবাহিনীতে বিরাট সংখ্যায় ছিলেন আফগানরা। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহ সুরির বংশধর হাকিম খান সুরি। স্পষ্টতই ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে হিন্দু বা মুসলিম কোনও পক্ষই সেই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। পাশাপাশি মুঘল রাজ পরিবার ও রাজপুত রাজ পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে। ‘লাভ জিহাদ’ বলে তখন কিছুই ছিল না। সেই সময়ের ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণা ও আত্মজীবনীতে তার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

এই প্রসঙ্গেই থাপার বলেছেন, ভুয়ো সংবাদের প্রচার আজকের দিনে ইতিহাস চর্চায় বিরাট সমস্যা তৈরি করছে। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের ভিত্তিতে লেখা ইতিহাস এবং অপ্রশিক্ষিত ঐতিহাসিকদের বদলে পেশাদার ইতিহাসবিদদের লেখা ইতিহাসই বিদ্যালয় স্তরে শেখানো উচিত।


ভাষণ শেষ করেছেন তিনি প্রশ্ন তুলে— ‘‘হেরোইন-আসক্ত এবং আফিমের সম্পর্ক এমনই থাকতে দেব কি আমরা? না কি আমরা চাইব, আফিমে বুঁদ হেরোইন-আসক্ত নিজেই নিজের কল্পনাকে প্রশ্ন করুক? না কি আমরা আফিমের গুণমানের পুনর্মূল্যায়ন করব?’’ থাপার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘প্রশ্ন করলে তবেই তো জ্ঞানের প্রসার ঘটে।’’


 

Comments :0

Login to leave a comment