গল্প | নতুনপাতা
খোলসে মাছ
গৌতম রায়
কবরস্থান মাঠের পশ্চিমে, চাঁদসীর ডাক্তার নিরোদ মিত্তিরের বাড়ির পাশে তখন ছাইগাদার মধ্যে দিয়ে নামা যেত গঙ্গায়।ঘাটের বালাই ছিল না।ঝুরঝুরে মাটি গড়িয়ে পড়তো জলে।সেই গড়ান্তির তালেই কখনো কখনো নেমে পড়তাম পা ডোবানো জলে।ভোলা, ইব্রাহিম আগে থেকেই তৈরি হয়ে আসতো।তবে বাড়িতে বলতো না গঙ্গায় নাইতে যাবে।ওদের সকলের ই বাড়ির লোকেরা জানতো মিউনিসিপ্যালিটির টাইম কলে যাচ্ছে চান করতে।
বড় রাস্তার উপরে ফণি বিশ্বাসের বাড়ি ঢুকতেই ছিল একটা পৌরসভার কল। কলের চারদিকে ইঁটের গাঁথনি।সিমেন্টের প্ল্যাস্টার।কলে ঢোকার মুখেও উঁচু ইঁটের চৌকাট।অনেকটা ঘরের চৌকাটের মতোই।
বৈকুন্ঠ দাসের বাড়ির ছেলেরা কলের চৌহদ্দির মধ্যে যে জল বেরোনোর ছ্যাঁদাটা ইঁট দিয়ে বন্ধ করে দিতো। বেশ খানিকট জল জমে কলপার টা অপেকটা চৌবাচ্চা হয়ে যেত।
আমার অবশ্য সেখানে স্নানের সুযোগ না হলেও ইব্রাহিমদের সঙ্গে প্রথম যেদিন মাঠের প্রান্তে চলে এসে ঢালু বেয়ে গঙ্গায় নামলাম, একটু গা ছমছম করছিল বই কী।গড়ান্তির মজা নিতে গিয়ে ঝপ করে পড়লাম জলে।একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেলাম! এই রে ডুবে যাব না তো?
দেখি হাতটা টেনে রেখেছে ইব্রাহিম। পড়ি পড়ি করেই আর গড়িয়ে পড়লাম না গঙ্গার জলে।পড়লে কি হতো- ভাবতে এখন হাত পা হিম হয়ে গেলেও ,সেদিন অবশ্য ভাববার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি তখনও ততো একটা যে গজিয়ে ওঠে নি, তাইই রক্ষে।তাহলে আবার নার্ভাস ব্রেকডাউনের জন্যে বাপ- মা কে ছুঁটতে হতো সাঁই ডাক্তারের কাছে।
আমাদের গলির মোড়ে সিংহাসনের বিড়িতে আসতেন সাঁই ডাক্তার।তখন এ চত্ত্বরে তার বেজায় নাম ডাক।বড় ডাক্তার আমাদের পাড়ায় আসে বলে মায়ের মাসী, মামা - যে যেখানে থাকতেন, চলে আসতেন তাকে দেখাতে।আর এসব আত্মীয় স্বজন আসা মানে সেদিনের মত পড়ার ঘরে অঘোষিত তালা।মায়ের সেসব মাসী, মামারা যে অসুখে ডাক্তার দেখাতে আসুন না কেন, আমার দিদিমার হাতের রান্না না খেয়ে তারা ডাক্তার বাড়ি মুখো হতেন না।
আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে সাঁই ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেই পিচ্চি বয়সেই শিখে ফেলেছিলাম ডাক্তার দেখানোর এক বিরাট কৌশল।তাই আমাকে যখন বিশেষ ঠেকায় পড়ে একবার মা আর ছোটমাসী সেই সাঁই ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল সিংহাসনের বাড়ি, ডাক্তার যত বলেন ; শুয়ে পড়ো।আমি কিছুতেই শুতে চাই না।
দু একবার ডাক্তারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করবার পর, ছোটমাসী যখন একটু কড়া সুরেই আদেশ করলে; ডাক্তারবাবু ওই বেঞ্চে শুতে বলছেন, শোও।
বেশ করুন সুরেই আমি বলে উঠলাম; শুয়ে দেখলেই তো উনি দশ টাকা নেবেন।বসে দেখলে পাঁচ টাকা।শুধু শুধু বেশি টাকা দেবে কেন?
আমার কথা শুনে , মা- মাসীর ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা হয়েছিল কি না বোঝবার মত ক্ষমতা তখন আমার না হলেও এখন মনেহয়, তারা নিশ্চয় ই ভেবেছিল ; এ ছেলে বড় হয়ে ইকনমিক্স না পড়ে যায় না।ভাগ্যিস , আম বাঙালি তখনও শেয়ার মার্কেট নিয়ে তেমন একটা সড়গরো হয়ে ওঠে নি আর কী।হলে পরে ধরেই নিতো, বড় হয়ে এ ছেলে শেয়ার বাজারের দালাল না হয়ে যাবে না!!
তা সেই গঙ্গার জলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম আমার মনে কোনো আতঙ্ক ই তৈরি করতে পারলো না। ইব্রাহিম হাত টেনে ধরেছে বলে একটু জলে পড়েও তেমন ভিজি নি- সেসব মালুম করবার আগেই দেখি জলের মধ্যে দু হাত দিয়ে গামছা ডুবিয়ে দিয়েছে ভোলা।
আমি একটু ধাতস্ত হয়েছি দেখে ভোলার একহাত থেকে গামছাটা নিয়ে ইব্রাহিম আর ভোলা একসঙ্গে ডুব দিয়েছে জলে।
ওমা, যেই উঠেছে , গামছাতে কি সুন্দর ছোট ছোট ঝকঝকে রঙিন মাছ।
দ্যাখ, দ্যাখ পিয়াল- কেমন খোলসে মাছ উঠেছে।কি গেলেস( গ্লেস) দেকতে পাচ্চিস পোনা গুলোর- চেঁচিয়ে উঠলো ইব্রাহিম।
আমার জীবনে সেই প্রথম স্বচক্ষে মাছধরা দেখা।মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছি আমি।চোখে রঙিন খোলসে মাছের ঝিলিক যেন ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে।
কি সুন্দর রে মাছ গুলো-- কি অদ্ভূত রঙ--
আমার কথার জবাবে ইব্রাহিম বললো; নিবি তুই মাছ গুলো?
চোখ দুটো আমার চকচক করে উঠলো।
দিবি তুই?
কেন দেব না?
আমার মনে একটু ভয় , যদি দিদিমা বকে।
ততোক্ষণে জলের ভিতরে পড়ে থাকা একটা ভাঙা মাটির হাড়ি,জানি না সেটা মুক্তোপুর শ্মশানের কি না, তার মধ্যে মাছ গুলোকে ভরে ফেলেছে ইব্রাহিম।
তিন জনে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে বাইরের ঘরের জানলা দিয়ে দেখি দিদি পড়ছে।জানলা বেয়ে উঠে দিদিকে বলতেই প্রবলেম সল্ভ।দিদি চুপি চুপি কলঘরের বড় চৌবাচ্চাতে মাছ গুলো ছেলে দিলো।
তারপর বাজারে চিনির সঙ্কটের জন্যে মোটা দানার চিনি একটা যে কাঁচের বয়ামে ভরে কাঠের আলমারিতে দিদিমা রেখেছিল, সেই বয়ামটা ম্যানেজ করলো দিদি।
অসময়ের জন্যে জমিয়ে রাখা এক বয়াম চিনি দিয়ে ছোটমাসী বানিয়ে ফেললো মুগের পুলি।ওই চিনি দিয়ে কিছু একটা পিঠেপুলি করবার ইচ্ছে ছোটমাসীর ও অনেকদিন ছিল।কিন্তু ঠিক সুযোগ করে বলে উঠতে পারছিল না।
দিদি আর আমি যখন ওইই বয়ামেই মাছ রাখার বায়না জুড়লাম,ছোটমাসীও যুক্তি হাজির করলো দিদিমার কাছে;
আরে ওভাবে ঠাঁসা আলমারি চিনি রেখে দিলে তো গলে যাবে।দেখবে তুমি,ব্যবহারের সময় আর কিছুতেই কাজে লাগবে না।মোটা দানার চিনিতে মিষ্টিটিষ্টি তৈরি হয়।ওই চিনি দিয়ে কি আর চা হয়, না তরকারিতে দেওয়া যায়? ববি, পিয়াল যখন বায়না ধরেছে , দেখো , ওই বয়াম তোমার আস্ত থাকে কি না!
ছোটমাসী আমাদের দস্যিগিরি নিয়ে যাই বলুক না কেন , আমরা কিন্তু মোটেই তেমন একটা দস্যি ছিলাম না।
তবে বেশ রসিয়ে রসিয়ে সবাই মিলে মুগের পুলি সবাই মিলেই খেয়েছিলাম।
আমাদের মস্ত বারান্দায় চা করবার মস্ত টেবিলে বয়ামে খেলে বেড়াতে লাগলো রঙচঙে খোলসে মাছ।
তবে মাছ আনা আর বয়াম উদ্ধার করে , সেটা পরিস্কর করে তাতে মাছ ছাড়া-- এসব করতে বেশ কয়েকটা দিন গেছিল।তাই কলঘরের চৌবাচ্চার আঁশটে জল পরিস্কার করে , চুন দিয়ে ঘসে চৌবাচ্চা পরিস্কার-- সবটাই দিদিকে আর আমাকে মিলেই করতে হয়েছিল।
Comments :0