মীর আফরোজ জামান- ঢাকা
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি আলোচিত খুন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২ মার্চ দিন ধার্য করেছেন ঢাকার একটি আদালত। এ নিয়ে ১১৫ বারের মতো প্রতিবেদন দাখিলের বেঁধে দেয়া সময় পার করলো তদন্ত সংস্থা।
সোমবার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। ওইদিন তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জি এম ফারহান ইশতিয়াক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন দিন ধার্য করে নির্দেশ দেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়। পরে নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি খুনের মামলা দায়ের করেন।
অন্তবর্তীকালীন সরকার গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুনের মামলার তদন্তের দায়িত্ব র্যা ব থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মাধ্যমে গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বহুল আলোচিত সাগর রুনিখুনের মামলার তদন্ত চেয়ে আনা রিটের আদেশ মডিফিকেশন চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে এ নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।
বিষয়টি নিয়ে শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘আশা করি এবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে এবং তদন্তের জন্য দেয়া এবারের ছয় মাস মানে ছয় মাস।’ এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৬ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে হাইকোর্টে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে শিশু মাহির সরওয়ার মেঘ।
নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন রুনির ভাই নওশের আলম। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। পরবর্তীতে মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে র্যা ব পায় তদন্তের দায়িত্ব।
এই হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। ঘটনার দুই মাস পরেও মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছিলেন। ইতোমধ্যে একযুগ পার হলেও মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে ১১৫ বার সময় নেওয়া হলো ।
এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনীদের ধরা হবে বলে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। তা শুধু কথার কথা হিসেবেই ছিল। সাগর রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবিতে ডিইউজে, বিএফইউজে, ডিআরইউসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন দাবি জানিয়ে আসছে।
র্যা ব এই মামলার তদন্তে নেমে গ্রেফতারকৃত আট আসামি, নিহত সাগর-রুনি এবং স্বজনসহ ২৫ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পাওয়ার পর অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনা করে দুইজনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পেয়েছে। তবে তাতে সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি বলে সূত্র জানায়।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ২১ সেপ্টেম্বর সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া তার অভিভাষণে বলেন, ‘আমরা দেখেছি চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে শতাধিকবার সময় নেয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। তদন্ত কাজেই যদি একাধিক বছর সময় লেগে যায়, সে মামলার বিচারকাজ পরিচালনা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা সময়ের আবর্তে মামলার অনেক সাক্ষী ও সাক্ষ্য হারিয়ে যায়।’
সাগর-রুনি হত্যা মামলায় এক যুগ পর বাদী পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান আইনজীবী নিয়োগের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উন্মোচনে কাজ শুরু করেছি।’
উল্লেখ্য যে, ১৯৯২ সাল থেকে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। বেশীর ভাগ হত্যাকান্ড খুলনা অঞ্চলে। ওইসব এলাকা ভারত সিমান্ত হওয়ায় চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে নিউজ করার কারণে সাংবাদিকদেরকে নির্মম ভাবে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে খুলনার মানিক সাহা, হুমায়ন কবীর বালু ও যশোরের সামছুর রহমান হত্যাকান্ড চোরাকারবারীদের টার্গেটে হয়। বিশেষ করে সামছুর রহমান হত্যাকান্ডের মুল হুকুমের আসামী ছিল ফারাজী আজমল হোসেন। এই ফারাজী ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার যশোরের দায়িত্বে। তৎকালীন আওয়ামি লিগ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে পুলিশ চার্জশিট থেকে তার নামাট বাদ দিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত সামছুর রহমানের পরিবার বিচারের আশায় ঘুরছে। ১৬ জুলাই ২০০০ সালে যশোরে অফিসের ভিতর ঢুকে দুর্বত্বরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ পর্যন্ত কোনো সরকার সাংবাদিকদের হত্যার বিচার করেনি।
Comments :0