মুরলিধরন
গত ২৭ জুন ছিল হেলেন কেলারের ১৪৫ তম জন্মবার্ষিকী, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বহু বাধা অতিক্রম করে যিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার নিজের সময়কালের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু যে বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষিত রয়ে যায় তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে হেলেন কেলার শুধুমাত্র একজন অনুপ্রেরণার প্রতীক নন, তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মীও। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি সেই অগ্রদূতদের একজন যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত শোষণ ও মুক্তির প্রসঙ্গে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পথ দেখিয়েছিলেন। এই সেই সত্য যা আজও অনেকাংশেই চেপে রাখা হয়েছে।
মূলগতভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী
আজ যদি হেলেন কেলার জীবিত থাকতেন, যদি তিনি প্যালেস্তাইনে গণহত্যা, সার্বভৌম ইরানের ওপর ইজরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অহেতুক ও নির্লজ্জ আগ্রাসনের এমন ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করতেন, তাঁর প্রতিক্রিয়া কেমন হতো? নিঃসন্দেহে তিনি এই আগ্রাসনকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করতেন। কেলারের যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট, পুঁজিবাদ ও শ্রেণি শোষণের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনার অঙ্গ। তিনি যুদ্ধকে শাসক শ্রেণির একটি হাতিয়ার হিসাবে দেখতেন। যুদ্ধ হলো এমন এক উপায় যার মাধ্যমে বিত্তবান শ্রেণি নিজেদের সম্পদ ও ক্ষমতা রক্ষার জন্য শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে বলি দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের এক তীব্র সমালোচক হিসাবে ঐ যুদ্ধকে একটি পুঁজিবাদী প্রকল্প হিসাবে নিন্দা করেছিলেন হেলেন কেলার। ১৯১৬ সালের একটি বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা করেন— ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করো, কারণ তোমাদের ছাড়া কোনও যুদ্ধ লড়া সম্ভব নয়!’ তাঁর এই প্রগতিশীল অবস্থানের জন্য তাঁকে এমন অনেকের সমালোচনার মুখে পড়তে হয় যারা কেলারকে শুধুই এক দৃষ্টিহীন ও শ্রবণহীন মানুষের ব্যক্তিগত জয়গাথার প্রতীক হিসাবেই দেখতে চেয়েছিল।
এক দায়বদ্ধ সমাজতান্ত্রিক
তাঁর যুদ্ধবিরোধী সক্রিয়তা ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। তাঁর মতে শান্তি মানে শুধু সংঘাতের অনুপস্থিতি নয় বরং ন্যায়বিচারের উপস্থিতিও। অর্থনৈতিক, জাতিগত ও লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচার। তাঁর শান্তির ধারণা এমন এক সমাজের দাবি জানায় যেখানে বৈষম্য ও হিংস্রতাকে টিকিয়ে রাখে এমন সকল ব্যবস্থা যেমন পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
হেলেন কেলার দেশপ্রেমের নাম করে অন্যায্য প্রচারকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিপীড়িত জনগণের আন্তর্জাতিক সংহতির ডাকও দিয়েছিলেন। একাজের মাধ্যমে তিনি তাঁর সময়কার এমনকি আজও প্রচলিত সেই বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন যেখানে যুদ্ধকে বীরত্বের প্রতীক আর শান্তিকে নিষ্ক্রিয়তার লক্ষণ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শান্তির জন্য কেলারের অনড়-অটল অঙ্গীকারই তাঁকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে প্রগতিশীল ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণে পরিণত করেছে।
ধনী-সচ্ছল এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাত্র ১৯ মাস বয়সে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি দুটোই হারিয়ে ফেলেন। অন্ধ ও বধিরদের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের শাখা র্যা ডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৪ সালে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন দৃষ্টিহীন ও শ্রবণশক্তিহীন ব্যক্তির পক্ষে সেই প্রথম এমন একটি কৃতিত্ব অর্জিত হয়। র্যা ডক্লিফে থাকাকালীনই তিনি প্রগতিশীল চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন যার মধ্যে কার্ল মার্কসের ভাবনাও ছিল। এসব চিন্তাধারা তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক সক্রিয়তায় গভীর প্রভাব ফেলে। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের আচরণই শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও গড়ে ওঠা বৈষম্য নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন।
১৯০৮ সালে হেলেন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক পার্টিতে যোগ দেন। শ্রমিক অধিকার, মহিলাদের ভোটাধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার এবং জাতিগত সমতার পক্ষে জনসভায় বক্তৃতা দিতে ও প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তাঁর কাজের মূল লক্ষ্যই ছিল দারিদ্র এবং অন্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক কারণসমূহ। তিনি বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদ আগের চাইতে পরবর্তী পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও কঠোর করে তুলেছে।
প্রতিবন্ধকতা: এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুর্দশা সম্পর্কে তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা, নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ ও দুর্বল স্বাস্থ্যপরিষেবার কারণে যারা প্রতিবন্ধি হতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের সমস্যাটি সরাসরি কর্পোরেট লোভ এবং সরকারের অবহেলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই উপলব্ধি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন তাঁর পরিবার সম্পদশালী বলেই তিনি নিজের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উন্নতি করতে পেরেছেন, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই এমন সুযোগ থাকে না।
তিনি প্রতিবন্ধকতাকে শুধুমাত্র চিকিৎসা সংক্রান্ত বা ব্যক্তিগত সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করতেন না। তিনি একে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা বলেই চিহ্নিত করেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে দারিদ্র, শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং শ্রমের বিপজ্জনক পরিবেশ, এসবই প্রতিবন্ধকতার কারণ। প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা অনেকেই সচেতনভাবে এসব প্রসঙ্গকে উপেক্ষা করেন।
গণমাধ্যম: উদ্যাপন থেকে বিরুদ্ধাচারণ
জীবনের শুরুতেই আমেরিকান মিডিয়া তাঁকে প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসাবে, ব্যক্তিগত অধ্যবসায় ও "আমেরিকান স্পিরিট" এর প্রতীক হিসাবে উদ্যাপন করেছিল। তবে যখন তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করতে শুরু করেন এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে আওয়াজ তোলেন, তখন সেটি দ্রুত শত্রুতা ও অবজ্ঞায় পরিণত হয়।
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসে যা আজও বিদ্যমান: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাধারণত কেবল তখনই প্রশংসা করা হয় যখন তারা প্রচলিত সমাজের নির্ধারিত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মানদণ্ডে খাপ খায়। কিন্তু যখন তারা রাজনৈতিক মতামত, বিশেষ করে চরমপন্থী মতামত ব্যক্ত করেন, তখন তারা অবহেলা বা নিন্দার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন।
ডেট্রয়েট ফ্রি প্রেস ১৯১৪ সালে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল: ‘যতদিন মিস কেলার সমাজের একজন সদস্য হিসাবে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে গৌরবময়ভাবে সংগ্রাম করছেন এবং তাঁর উদাহরণের মাধ্যমে দুর্ভাগ্যপূর্ণ অবস্থায় থাকা অন্যদের প্রেরণা জোগাচ্ছেন, ততদিন তিনি মূল্যবান কাজ করছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার ওপর একপ্রকার কর্তৃত্বপূর্ণ ভাষ্য দিতে উদ্যত হন তখন তিনি তাঁর জ্ঞানের পরিমাণ ও বিচারের তুলনায় অতিরিক্ত মনোযোগ ও সমালোচনার সম্মুখীন হন।’
‘হেলেন কেলার একজন বধির-বাক ও অন্ধদের জন্য আলোর পথ দেখাতে সংগ্রামরত, তিনি অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। সমাজতন্ত্র প্রচারে হেলেন কেলার;  ধর্মঘটের সুফল তুলে ধরছেন হেলেন কেলার; মার্কিন সংবিধানকে অবজ্ঞার চোখে দেখছেন হেলেন কেলার— এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি করুণ। তিনি নিজের সামর্থ্যের বাইরে কথা বলছেন। তার জ্ঞান প্রায়শই কেবল তাত্ত্বিক, আর দুঃখের বিষয়, এই পৃথিবী এবং এর সমস্যা দুটোই অত্যন্ত বাস্তবিক।”
এসব সমালোচনার উত্তরে কেলার লিখেছিলেন: ‘আমি সংবাদকর্মীদের পছন্দ করি। আমি অনেককেই চিনেছি, এবং দুই-তিনজন সম্পাদক আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যেও ছিলেন। অন্ধদের জন্য আমরা যে কাজ করার চেষ্টা করছি তাতে সংবাদপত্রগুলি বড় সাহায্য করেছে। অন্ধদের জন্য কাজ এবং অন্যান্য সাধারণ দাতব্য কার্যক্রমে তাদের সাহায্য দিতে কোনও দ্বিধা হয় না। কিন্তু সমাজতন্ত্র! আহ! সেটি একেবারে আলাদা কথা! এ হলো সমস্ত দারিদ্র্য ও দাতব্য কার্যক্রমের মূলে যাওয়া। সংবাদপত্রের পেছনে থাকা অর্থশক্তি সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সম্পাদকেরা তাদের প্রতি আনুগত্যশীল, সমাজতন্ত্রকে দমন এবং সমাজতান্ত্রিকদের প্রভাব কমানোর জন্য তারা যে কোনও চেষ্টাই বাকি রাখবে না।’
নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে স্বাভাবিক সমাজের বাইরের থাকা এক ব্যক্তি হিসাবে পরিচয় দেয়। তিনি এর প্রত্যুত্তর দেন: ‘আমি কোনও রঙের কাপড়েরই ভক্ত নই, তবে আমি লাল পতাকাকে ভালোবাসি। আমার স্টাডিতে একটি লাল পতাকা ঝুলিয়ে রাখা আছে। যদি পারতাম, আনন্দের সঙ্গে সেটি সঙ্গে নিয়ে টাইমসের অফিসের সামনে যেতাম এবং সমস্ত সংবাদদাতা ও ফটোগ্রাফারকে সেই দৃশ্যটি উপভোগ করতে দিতাম। টাইমসের ব্যাপক নিন্দা অনুযায়ী আমি সম্মান ও সহানুভূতির সব অধিকার হারিয়েছি। আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। তবু টাইমসের সম্পাদক চান আমি তাঁর জন্য একটি প্রবন্ধ লিখি! আমি যদি সন্দেহভাজন ব্যক্তিই হই তবে তিনি কী করে আমায় বিশ্বাস করবেন? আমাকে লেখার সুযোগ দিলে আপনি নিচু মানের নৈতিকতা, খারাপ যুক্তি, খারাপ শিষ্টাচার উপভোগ করবেন। পুঁজিবাদী আদর্শে আস্থাশীল একজন সম্পাদক এমনভাবেই পুঁজিবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনকে নিন্দা করে নিজের অবস্থান প্রকাশ করেন। আমরা সহানুভূতির দাবি রাখি না, তবু আমাদের কেউ কেউ এমন প্রবন্ধ লিখতে পারি যা তাঁর কাগজকে টাকা উপার্জনে সাহায্য করবে। সম্ভবত আমাদের মতামত তাঁর কাছে ততটাই মূল্যবান যা তিনি কোনও এক বিখ্যাত হত্যাকারীর স্বীকারোক্তিতে খুঁজে পেতেন। আমরা স্নেহযোগ্য নই, তবে আমরা আকর্ষণীয় তো বটেই।’
হেলেন কেলারের কাজ- প্রাসঙ্গিকতা
সাহস, অধ্যবসায় এবং বুদ্ধিবৃত্তির চিরস্থায়ী প্রতীক হিসাবে হেলেন কেলার আজও স্মরণীয়। তবে শুধুমাত্র একজন প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হিসাবে তাঁর কৃতিত্বকে সীমাবদ্ধ রাখলে তার প্রতি অন্যায় হবে। কেলার ছিলেন একজন বিপ্লবী। যিনি কেবল নিজের ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতাগুলিকেই অতিক্রম করেননি বরং নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যবহার করে অন্যদের প্রতিবন্ধকতাও চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রতিবন্ধকতা, সক্রিয়তা এবং ন্যায়ের জন্য সত্যিকারের সংগ্রামের অর্থ বুঝতে তাঁর জীবন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার, স্বাস্থ্যপরিষেবার অধিকার এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক বৈষম্য আজকের পৃথিবীতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই হেলেন কেলারের কাজ আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0