RG KAR JUSTICE

সুবিচারও ছিনিয়ে আনতে হয়

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী
"ধর্ষিতা তুই! তোরই কিন্তু দোষে!" — কলেজের কুলাঙ্গার অধ্যক্ষের মুখনিঃসৃত এই বাণী শুনতে পেল না মেয়েটি, কারণ কেবল ধর্ষণ করেই তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি, ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ গলা উঁচিয়ে বলেছেন, সেমিনার রুমে রাতে কেন সে গেছিল একাকী! তারও আগে অনুপ্রাণিত অধ্যক্ষ তাকে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য মেয়েটির অর্ধনগ্ন, আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন শবদেহটি আবিষ্কারের পর সর্বাগ্রে তিনি চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যার তকমা লাগাতে। পরিবারকে জানানো হয়, মেয়ে আত্মঘাতী। ঠিক যেমনটি কোভিডকালে তিনি জানিয়েছিলেন ডাঃ পৌলমী সাহার পরিবারকে। সেদিনও ছিল শুক্রবার, সময়টাও ছিল বেলা ১১-টা। ধপ করে সজোরে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে লোকজন দৌড়ে গিয়ে দেখতে পান শিশুবিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি পৌলমীর রক্তাক্ত মৃতদেহ। বলা হয়েছিল ডিপ্রেশনে ভুগে হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের ছ'তলা থেকে সে নাকি ঝাঁপ দিয়েছে। অথচ তার বন্ধুমহল, পরিবার কেউ জানত না তার ডিপ্রেশনের কথা। কোনও সুইসাইড নোটও মেলেনি। ২০২০ সালের মে দিবসের ঘটনা। লকডাউনের সময়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দিনের আলো দেখেনি। পুলিশি তদন্তের ফলাফলও মিডিয়ায় আসেনি।
রবিবার বিকালে নিজের বাড়িতে বসে মেয়েটির শোকবিহ্বল বাবা আমাদের বলছিলেন যে আপনারা সবাই দ্রুত আন্দোলনে না নামলে আদৌ মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পেতাম কিনা সন্দেহ। মেয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখবার জন্য অধ্যক্ষ তিনঘণ্টা কলেজে বসিয়ে রেখেছিলেন ওঁদেরকে। সদ্য সন্তানহারা পিতা বলছিলেন আপনারা না থাকলে ময়নাতদন্তটাই হয়তো হতো না। তিনি আরও জানালেন যে তাঁরা শববাহী গাড়ির আগে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ ফিরতে দেয়নি। মেয়ের মৃতদেহ সৎকারে পুলিশ আর কলেজ কর্তৃপক্ষ এত তাড়া দিয়েছে যে হতভাগ্য মেয়েটির পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-পরিজন, সহকর্মী, সহপাঠীরা তাকে শেষ দেখার সুযোগটুকুও পাননি। আর তার শীর্ণকায় মা চোখ মুছে আমাদের বলছিলেন, কাঁধে স্টার লাগানো পুলিশের এক বড়কর্তা মেয়ের অন্ত্যেষ্টির আগেই তাঁকে বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রফার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পাশেই ছিলেন তার বাবা। তিনি গর্জে উঠে বলেন, আপনি যেমন অনেক পরিশ্রম করে কাঁধের ঐ স্টারগুলো অর্জন করেছেন, আমার মেয়েও তেমনি বহু অধ্যবসায়  চিকিৎসক হয়েছে, খামোখা আমার মৃতা মেয়েকে অপমান কেন করছেন!
পুলিশের পক্ষ থেকেও প্রথমে আত্মহত্যাই বলা হয়েছিল। পরে ঢোঁক গিলে কমিশনার কবুল করেন খুন ও ধর্ষণের কথা। এবার প্রশ্ন উঠে এল অনেকগুলো। খুনি আর ধর্ষক কি একই ব্যক্তি, না আলাদা? একক ধর্ষণ, না দলবদ্ধ ধর্ষণ? দলবদ্ধ ধর্ষণ হলে কতজন ধর্ষক?
দেড়দিন পরে একজনকে ধরা হলো সিসিটিভি ফুটেজ ও হেডফোনের সূত্রে। ধৃত সিভিক পুলিশ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নাকি দোষ কবুল করে নিজেই নিজের ফাঁসির আবেদন করল। পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করল সে একাই ধর্ষক ও খুনি এবং সে সাইকোপ্যাথ। সে নাকি খুন করে তারপর মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম করেছে। তার সাইকো-অ্যানালিসিস কখন হলো, কে করল জানা নেই।
ইতিমধ্যে অনেকগুলি অডিও ক্লিপ ও স্ক্রিনশট ভাইরাল হলো। পাশাপাশি সুবিচার-প্রত্যাশী চিকিৎসক, ছাত্র-যুব-মহিলা সহ নাগরিকদের আন্দোলন ক্রমশঃ ব্যাপ্ত হতে থাকায় পুলিশ বাধ্য হলো বাকি সিসিটিভিগুলির ফুটেজ খতিয়ে দেখে আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কিন্তু তা করতে সময় লেগে গেল চারদিন! অপরাধবিজ্ঞান ও ফরেন্সিক মেডিসিনে সময় এক বড় অস্ত্র। এমনিতেই মিডিয়ায় ক্রাইম সিনের ভিডিও থেকে স্পষ্ট যে ঐ সেমিনার হলো সিল করা হয়নি, ফলে পায়ের ছাপ, আঙুলের ছাপ ইত্যকার প্রমাণ নষ্ট তথা লোপাটের যথেষ্ট অবকাশ রেখে দেওয়া হয়েছিল। তার উপর সন্দেহভাজনদের জেরা ও মেডিক্যাল টেস্ট অপরাধের চারদিন পর করলে সম্ভাব্য অপরাধী বা অপরাধীরা যেমন তাদের অ্যালিবাই সাজিয়ে নেবার সুযোগ পায়, তেমনি তাদের শরীর থেকে এধরনের অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলারও ফুরসত পেয়ে যায়।
ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ কেন, সাধারণ একটা চুরি হলেও তদন্তকারীরা সবার আগে সন্দেহভাজনদের তালিকা করে একে একে ডেকে জেরা করে। এক্ষেত্রে ঘটনার ঐ রাতে কাদের ডিউটি ছিল তা রোস্টার দেখলেই পাওয়া যেত, ডিউটি ছাড়াও কেউ ঢুকেছিল কিনা তা সিসিটিভি ফুটেজেও পাওয়া গেছে। তাদের ডাকতে চারদিন লাগল কেন? অধ্যক্ষ পদত্যাগের নাটক ও তারপর বদলির আদেশ বেরোনোর পরেই তাদের ডাক পড়ল প্রথম। কেন? অধ্যক্ষের কী ভূমিকা? তাঁকেই বা জেরা করা হচ্ছে না কেন? তাঁর মোবাইল ফোন হেপাজতে নেওয়া হচ্ছে না কেন? 
জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টর্সের সাত চিকিৎসক প্রতিনিধিকে রবিবার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখান মৃতার পরিবার। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। মাথার খুলির নিচে বহু জায়গায় রক্তক্ষরণ, মুখমণ্ডলে অসংখ্য ক্ষত, গলায় একাধিক কালশিটে, গলার তরুণাস্থি ভাঙা। হাত, পা, কাঁধ, হাঁটু ও গোড়ালিতে চোট, হাতের নখ ও যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত। কোন হাড়ে ফ্র্যাকচার নেই। অবশ্য শবদেহের এক্স-রে করানো হয়েছে কিনা তাও লেখা নেই। কিন্তু এটা স্পষ্ট লেখা যে বলপূর্বক ধর্ষণ হয়েছে এবং সমস্ত আঘাতগুলি মৃত্যুর আগেই হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের আগেভাগেই গেয়ে রাখা মৃতদেহের সঙ্গে ধৃতের সঙ্গমের তত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে গেছে। এখন তাদের সাইকোপ্যাথ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ধৃতের অতীত খুঁজছে পুলিশ।
শবদেহ থেকে যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য, তার মধ্যে যোনিপথের গভীর থেকে সাদা, পুরু, থকথকে তরল নমুনার ওজন ১৫১ গ্রাম। এই তরল বীর্য হবার সম্ভাবনাই বেশি, সঙ্গে কিছুটা যোনিরস ও শ্লেষ্মা মিশে থাকতে পারে। এত পরিমাণ বীর্য একজনের সঙ্গমে ক্ষরিত হওয়া অসম্ভব। ফলে দলবদ্ধ ধর্ষণের সম্ভাবনা জোরালো।
মেয়েটির গাড়ি হাসপাতালের পার্কিং চত্বরেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘটনার দিনকয়েক আগে। তাহলে তাকে কি কোনভাবে টার্গেট করা হয়েছিল? আততায়ী বা আততায়ীরা কি তার পরিচিত, নাকি পরিচিতদের ভাড়া করা কেউ? পরিচিত হলে তারা কি সহকর্মী বা সহপাঠী?
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আমি। আমাদের ছাত্রজীবন কম ঘটনাবহুল ছিল না। কিন্তু ক্যাম্পাসে এরকম নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যা হতে পারে তা কোনোদিন কল্পনাতেও আসেনি। আসলে গত চার বছরে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নাম করে কয়েকজন ছাত্রকে অপরাধমূলক কাজে তালিম দেওয়া শুরু হয়। শিক্ষকদের বদলির হুমকি দিয়ে গণটোকাটুকি, কাকে কত মার্কস দিতে হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা, ক্যান্টিন ও অন্যান্য জায়গা থেকে তোলাবাজি, হাউসস্টাফদের আসন বরাদ্দের বিনিময়ে টাকা তোলা, মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্বাচনের ব্যালট ছিনতাই— তালিকা লম্বা। অধ্যক্ষের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ক্যাম্পাসে বিরোধীশূন্য ছাত্র রাজনীতির আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে বিরোধী সংগঠনের সকলকে উপর্যুপরি পরীক্ষায় ফেল করিয়ে ও ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে। ছাত্র রাজনীতির অর্থই বদলে ফেলা হয়েছে। অধ্যক্ষের বাছাই করা ছাত্র গুন্ডাদেরকেই নেতা বলে ঘোষণা করা হতো। সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের সুফলে ছাত্রদের উন্নত চেতনার যে উন্মেষ ও সুকুমারবৃত্তিগুলির যে বিকাশ ঘটে, তার কোনও পরিসর তো ছিলই না, বরং অপরাধপ্রবণতাকেই ছাত্র রাজনীতি বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। শুধুমাত্র ছাত্রগুন্ডাদের দিয়ে অপরাধের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতো না বলেই দাগী সিভিক ভলান্টিয়ার ও প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সির বাউন্সার দিয়ে বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। না পড়েই পরীক্ষায় পাশ, অনার্স মার্কস পাওয়ায় আর্থিক তছরুপের চুঁইয়ে পড়া প্রসাদে নেশা, ভোগ, বিনোদন বাড়তে থাকে তথাকথিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে। একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয় অধ্যক্ষের সঙ্গে এই ছাত্রগুন্ডাদের। অধ্যক্ষের তছরুপে  ছাত্রগুন্ডারা সাহায্য করবে, তাঁর বদলি হলে রুখে দেবে, তিনি মেডিক্যাল কাউন্সিলের ভোটে দাঁড়ালে ভোট লুট করবে। পরিবর্তে তিনি ছাত্রগুন্ডাদের ফুর্তিফার্তার উপযুক্ত পরিবেশ দেবেন, ফুর্তি করতে গিয়ে ফেঁসে গেলে তিনিই সুরক্ষা দেবেন। এই মিথোজীবিতার সঙ্গে তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের ঠিক কী যোগ রয়েছে তা খুঁজে বের করার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্যের সমাধান।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পরীক্ষা তো নেয় স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, তাহলে অধ্যক্ষ কিভাবে পাশ-ফেল-অনার্স ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করেন? অধ্যক্ষকে একাজে সাহায্য করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মাথা, যিনি নানান দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ও সম্প্রতি তাঁর পদ খুইয়েছেন। তাঁরও যেমন একটা পুনর্বাসনের দরকার ছিল, এই কীর্তিমান অধ্যক্ষেরও তেমনি ডেরা বদলের প্রয়োজন হলো তিলোত্তমা খুনের পরবর্তী গণআন্দোলনের চাপে। এখানেই লুকিয়ে অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও বদলির যাত্রাপালার বাকি অংশের হিসেবনিকেশ, যাতে সাপও মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে!
অবশ্য শেষরক্ষা হলো না আদালতের হস্তক্ষেপে। আপাতত ছুটিতে পাঠানো হয়েছে সদ্য-প্রাক্তন অধ্যক্ষকে। তদন্তের দায়ভার সিবিআই-কে দিয়েছে আদালত। কিন্তু আদালতের কড়া নজরদারি না থাকলে সিবিআই যে অশ্বডিম্ব প্রসব করে তাও জানে মানুষ। আদালত সিবিআই-কে তদন্তভার দেবার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকদের ডিউটি রুম বানানোর অছিলায় আর জি করের চেস্ট ডিপার্টমেন্টের কুখ্যাত, অভিশপ্ত সেমিনার রুমটির দেওয়াল ভেঙে প্রমাণ লোপাটের অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে না, গণআন্দোলনের চাপ এতটুকু আলগা করা যাবে না এখনই।
অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন উঠে এসেছে, প্রত্যেকটির উত্তর চাই আমাদের। আর এখানেই আমাদের অর্থাৎ চিকিৎসক সংগঠনগুলোর, ছাত্র-যুব-মহিলা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, বৃহত্তর নাগরিক সমাজের ভূমিকা। মোমবাতি জ্বালিয়ে শোকপ্রকাশের সময় নয় এখন, প্রতিবাদের মশাল হাতে রাজপথের দখল নিয়েই সবকটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে, ছিনিয়ে আনতে হবে সুবিচার। কবি সুকান্তের কথায়, 'দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম..'
 

Comments :0

Login to leave a comment