প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত বাকি ৬ জনকেও আগাম মুক্তির আদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি বিভি নাগরত্নের বেঞ্চ এই আদেশ দিয়েছে। এর আগে চলতি বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই আগাম মুক্তি পেয়েছেন রাজীব গান্ধী হত্যায় আরেক সাজাপ্রাপ্ত এজি পেরারিভালান। এদিন বাকি ৬ জনের মুক্তির আদেশ দিতে গিয়ে পেরারিভালান-রায়কেও নজির হিসাবে উল্লেখ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি, দোষীদের সাজা কমানোর জন্য ২০১৮ সালে তামিলনাডুর তৎকালীন এডিএমকে সরকারের সুপারিশের কথাও উল্লিখিত হয়েছে রায়ে।
সর্বোচ্চ আদালতের এদিনের রায়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ৬ জন হলেন নলিনী শ্রীহরণ, আরপি রবিচন্দ্রন, সান্থন, মুরুগান, রবার্ট পায়াস এবং জয়াকুমার। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতিরা বলেন, ‘‘এঁরা প্রত্যেকেই ২৩ বছরেরও বেশি কারাগারে কাটিয়েছেন। বন্দিজীবনে এই ৬ জনের আচরণ সন্তোষজনক এবং তাঁরা নানান পড়াশোনার মধ্যেই ছিলেন।’’ এছাড়া ‘‘এর আগে যে যুক্তিতে আরেক সাজাপ্রাপ্ত এজি পেরারিভালানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এই ৬ জনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য’’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে রায়ে।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিন আরও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘‘৩০২ধারায় সাজাপ্রাপ্ত ৬ জনের দণ্ড কমানোর আবেদন রাজ্যপালের কাছে জমা পড়লেও, তিনি রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শেই পদক্ষেপ করতে বাধ্য। বাস্তব হলো, এই ৬ জনের সকলেরই সাজা মকুবের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে তামিলনাডু মন্ত্রীসভা।’’
তামিলনাডু সরকার আগেই জানায়, সংবিধানের ১৬১ ধারা অনুযায়ী নলিনী এবং রবিচন্দ্রনের আগাম মুক্তির আবেদন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে রাজ্যপালের। এব্যাপারে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজ্য মন্ত্রীসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সুতরাং রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজ্যপালকে।’’
প্রসঙ্গত, ৩১ বছর আগে ১৯৯১ সালের ২১ মে রাতে তামিলনাডুর শ্রীপেরুমবুদুরে এক নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন রাজীব গান্ধী। শ্রীলঙ্কার তামিল উগ্রপন্থী গোষ্ঠী অধুনাবিলুপ্ত এলটিটিই’র পরিকল্পনায় ধানু নামে একজন মহিলা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান। দেশ-বিদেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজীব হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড দেয় বিশেষ টাডা আদালত। ঘটনা পরম্পরায় ১৯৯৯ সালের মে মাসের আদেশে পেরারিভালান, মুরুগান, সান্থন এবং নলিনীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।
এর মধ্যেই ২০০০ সালের এপ্রিলে প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি তথা প্রয়াত রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়ার আবেদন অনুসারে এবং তামিলনাডুর তৎকালীন সরকারের পরামর্শে নলিনী শ্রীহরনের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেন রাজ্যপাল। নলিনীর একটি কন্যাসন্তান রয়েছে, এই কারণেই তাঁর মৃত্যুদণ্ড কমানোর আরজি জানান সোনিয়া।
এর পরে ২০১১ সালের ১২ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন পেশ করেন মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত পেরারিভালান। তিনি ফের মাদ্রাজ হাইকোর্টে আবেদন করলে ২০১২ সালের ১ মে মামলা সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপরেই ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পেরারিভালান, সান্থন এবং মুরুগানের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সংশ্লিষ্ট তিনজনের ক্ষমার আরজি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্র ‘অস্বাভাবিক’ দেরি করায় এই রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
এর পরবর্তী অধ্যায়ে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংবিধানের ১৬১ ধারায় নিজের যাবজ্জীবনের শাস্তি মকুবের আবেদন জানান পেরারিভালান। ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর পেরারিভালানকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব নেয় তামিলনাডুর তৎকালীন এডিএমকে মন্ত্রীসভা। রাজ্যপালের কাছে সেই প্রস্তাব পাঠিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যপাল নিজে কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি পুরো বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি বিষয়টি ফেলে রাখায় এরপরে ‘‘৩১ বছরেরও বেশি জেলবন্দি রয়েছেন’’ যুক্তি দিয়ে ২০২২ সালের ৯ মার্চ পেরারিভালানের জামিন মঞ্জুর করে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরে গত ১৮ মে প্রায় একই কারণ দেখিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ নম্বর ধারা অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে শেষপর্যন্ত পেরারিভালানকে মুক্তি দিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ১৪২ নম্বর ধারায় বলা রয়েছে, ‘‘পূর্ণ বিচার’’ নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোনও রায় দিতে পারে শীর্ষ আদালত।
পেরারিভালানের মুক্তির পরে নলিনী এবং রবিচন্দ্রনও নিজেদের আগাম মুক্তির আবেদন জানান সর্বোচ্চ আদালতে। তারপরেই শুক্রবার নলিনী, রবিচন্দ্রন সহ বাকি ৬ জনের মুক্তি ঘোষণা করলো সুপ্রিম কোর্ট।
এদিকে রাজীব গান্ধী হত্যায় দোষীদের শাস্তি মকুবের তীব্র বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস। এদিন দিল্লিতে এক বিবৃতিতে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুল। এই পদক্ষেপ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’’
সুপ্রিম কোর্টের এদিনের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে তামিলনাডুর শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষই। এদিনের রায়ে রাজ্যপাল ও নির্বাচিত রাজ্য সরকারের সম্পর্কের ব্যাপারে যে উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করা হয়েছে, তা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্টালিন।
Comments :0