বিরোধীরা জাতগণনার দাবি তুলতো বলে এতদিন কটু মন্তব্য, বিষোদগারে ভরিয়ে দিতেন বিজেপি নেতারা। বিরোধী নেতাদের ‘বিভেদকামী’, ‘দেশবিরোধী’ এবং ‘শহুরে নকশাল’ বলে অহরহ গাল পেড়ে জাতগণনার দাবিকে সপাটে উড়িয়ে দিয়েই এসেছে মোদী সরকার বা বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা। সেই বিজেপি নেতারাই এখন ডিগবাজি খেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতগণনার সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে গদ গদ হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। আর এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে‘ব্যান্ড’ বাজাতে নেমে পড়েছে গোদি মিডিয়াও।
তবে এখন বড় গলায় ‘সাফল্য’ হিসাবে প্রচার চালানো শুরু হলেও মোদী সহ বিজেপি নেতাদের সেই সময়ের ন্যক্কারজনক মন্তব্যগুলি সমানতালে সামনে চলে আসছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীই স্বয়ং জাতগণনার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জাতগণনাকে ‘শহুরে নকশালদের ভাবনা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। এমনকি লোকসভা ভোটের প্রচারে কংগ্রেসকে বিঁধতে ‘মহিলাদের অলঙ্কার কেড়ে নেওয়ার ছক চলছে’ বলেও জাতগণনার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মোদী। একই সঙ্গে এসব ‘সমাজকে বিভাজনের চেষ্টা’ কিংবা এই ধরনের পদক্ষেপকে ‘পাপ’ বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এখন অন্যান্য বিজেপি নেতারা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে শোরগোল ফেললেও মোদী যদিও এখনও রয়েছেন নীরবই।
বিজেপি নেতারা জাতগণনা নিয়ে একের পর এক বিষোদগার করে গিয়েছেন এতদিন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ধারাবাহিকভাবে জাতগণনার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশকে টুকরো করতে জাতগণনা’র দাবি তোলা হচ্ছে। বিরোধীদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলতেও দ্বিধা করেননি। লোকসভা ভোটের সময় বিরোধীদের দাবিকে নস্যাৎ করে তিনি ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। জাতগণনার দাবি তোলার জন্য কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টির নেতাদের তিনি ‘জাতপাতের ব্যবসায়ী’ বলে তির্যক মন্তব্য করেছিলেন। সেই আদিত্যনাথ জাতগণনার সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করে বলছেন, ‘শুধু ঐতিহাসিকই নয়, বৈপ্লবিকও’।
বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা ২০১৯ সালে জাতপাতের রাজনীতি খারিজ করে দিয়ে দাবি করেছিলেন, ‘‘একটাই মাত্র জাত, সেটা গরিব’’। সেই নাড্ডার মুখে এখন জাতগণনা প্রসঙ্গে শোনা যাচ্ছে, ‘উন্নতির স্বার্থে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত’। একসময়ের বিজেপি সভাপতি, এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করে তাঁদের লাথি মেরে বের করে দেওয়া উচিত।’’ সেই গড়কড়ি এখন জাতগণনা সিদ্ধান্তে আপ্লুত!
জাতগণনা নিয়ে অত্যন্ত নিকৃষ্ট ভাষায় রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করেছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে লোকসভায় রাহুল গান্ধী জাতগণনার দাবি জানালে তিনি বলেছিলেন, ‘‘যে ব্যক্তির নিজেরই জাতের ঠিক নেই, তিনি জাতগণনার দাবি জানাচ্ছেন?’’ এখন অনুরাগ ঠাকুর মনে করছেন, জাতগণনার সিদ্ধান্ত হলো ‘সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ’। বিজেপি নেতাদের এই ধরনের ভোলবদলের রাশি রাশি উদাহরণ রয়েছে। ২০২৪ সালে মোদীর সুরে তাল মিলিয়ে অমিত মালব্য বলেছিলেন, ‘‘গরিব হিন্দু মহিলাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে সুবিধাভোগী ‘ভোট ব্যাঙ্ক’র মধ্যে পুনর্বণ্টন করতে চাইছে কংগ্রেস।’’ তাঁর ইঙ্গিত ছিল স্পষ্টতই মুসলিমদের প্রতি। এখন মালব্যের দাবি, জাতগণনা এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। স্মৃতি ইরানি কংগ্রেসের জাতগণনার দাবিকে উপহাস করে বলেছিলেন, ‘‘কংগ্রেস তার চেয়ে বরং নিজের দলের সদস্য কত, সেই গণনা করুক।’’ এখন স্মৃতির মুখে অন্য সুর, জাতগণনার সিদ্ধান্তকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘সামাজিক ন্যায় এবং সমাজের সব অংশকে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ।’’
বিজেপি নেতারা তখন কী বলেছিলেন আর এখন কতটা উচ্ছ্বসিত— তার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। বিজেপি’র অন্যতম মুখপাত্র সুধাংশু ত্রিবেদী একসময় বলেছিলেন, ‘জাতপাত আসলে একটা পেশা’। এখন সেই ত্রিবেদী জাতগণনার সপক্ষে সব জায়গায় উচ্চ কণ্ঠে প্রচার করে চলেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং জাতগণনার দাবি নস্যাৎ করে বলেছিলেন, ‘‘এগুলি উলটে গরিবদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করবে।’’ সেই গিরিরাজ সমাজ মাধ্যমে জাতগণনার ঘোষণাকে শেয়ার করছেন। আরেক নেতা তেজস্বী সূর্য জোর গলায় বলেছিলেন, ‘জাতগণনার বিরূপ প্রভাব পড়বে হিন্দু ঐক্যের ক্ষেত্রে, ফলে ওই দাবি খারিজ করা উচিত’। ডিগবাজি খেয়ে এখন কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে তিনি মশগুল। বিজেপি’র অন্যতম মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া জাতগণনা করা কোনোমতেই করা উচিত নয় গলা চড়াতেন তখন। এখন ‘পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জয়’ বলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের পঞ্চমুখ। জাতগণনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন বিজেপি সাংসদ তথা অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতও।
গত লোকসভা ভোটে জাতগণনা বিরোধীদের প্রচারের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নিয়ম করে প্রতিটি জনসভায় প্রতীকী সংবিধান তুলে ধরে জাতগণনার দাবি জানাতেন। তিনি বলতেন, ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ ক্ষমতায় এলে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই জাতগণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরই সঙ্গে তিনি সংরক্ষণের ৫০ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সিপিআই(এম) সহ অন্য বিরোধী দলও জাতগণনার সপক্ষে সরব ছিল। আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই বলতেন, ‘‘আমি বেশি কথা বলার পক্ষাপাতী নই। ওদের কান ধরে ওঠবস করিয়ে জাতগণনা চালু করাবো।’’ এখন জাতগণনার ঘোষণাকে মোদী সরকার সাফল্য হিসাবে তুলে ধরা চেষ্টা চালালেও বিরোধীরা মনে করছে, তাদের চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো কেন্দ্র।
তবে এরই পাশাপাশি জনগণনা কবে হবে কিংবা জাতগণনার তথ্য কীভাবে সংযোজিত হবে, সেই সময়সীমা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আবার চলতি বছরের শেষেই বিহারে বিধানসভা ভোট। বিহার ভোটের রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রেখে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র বলেও ধারণা করা হচ্ছে। নির্দল সাংসদ পাপ্পু যাদব কটাক্ষ করেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনার অন্ধ সমর্থকেরা এত দিন জাতগণনার বিপক্ষে সরব ছিলেন। আর এখন বাধ্য হয়ে তার পক্ষে মুখ খুলতে হচ্ছে তাঁদের! আপনি তো সমর্থকদের বিদূষক বানিয়ে দিয়েছেন!’ আরজেডি নেতা তেজস্বী প্রসাদ যাদবের মতে, “এই জয় আমাদের দলের, বিশেষ করে লালুপ্রসাদ যাদবের। আমরা সংসদ থেকে সড়ক— সর্বত্র জাতগণনার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলাম।” তবে কবে ওই জাতগণনার সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন লালুপ্রসাদ-তনয়।
কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে জাতগণনার সিদ্ধান্ত নিলেও আসলে এটা বিরোধীদের জয় বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এটা বুঝেই এখন এটা মোদী সরকারের সাফল্য হিসাবে তুলে ধরতে মরিয়া বিজেপি। একারণেই একসময়ের চরম বিরোধিতা করা বিজেপি নেতারাই নানা দিক থেকে ঢাক ঢোল পেটাতে শুরু করে দিয়েছেন। একারণেই বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটি বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে জাতগণনা সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে বিরোধীদের দিকেই তোপ দাগেন মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘‘বিরোধীরা জাতগণনাকে ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে। স্বাধীনতার পর মোদী সরকারই সেই কাজ করে দেখালো।’’ এমনকি কংগ্রেস সরকারে থাকাকালীন কেন জাতগণনা করেনি, সেই প্রশ্ন তুলে নিজেদের দিকের তির ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন মন্ত্রী।
এদিকে, শুক্রবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে কেন্দ্রের জাতগণনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কংগ্রেস মনে করে, এটা নিয়ে সংবিধান সংশোধনের পাশাপাশি সংরক্ষণের ৫০ শতাংশ ঊর্দ্ধসীমা তুলে দিতে হবে। এমনকি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু করতে হবে বলে দাবি তুলেছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে জাতগণনার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে।
caste census
জাতগণনাকে বিষোদগার করা বিজেপি নেতারাই এখন গদ গদ!

×
Comments :0