মমতা ব্যানার্জি বলছেন, টাকা নেই! টাকা খুঁজছেন তিনি। আর তাঁরই সরকার গ্রামোন্নয়নের প্রায় ২৯৪৪ কোটি টাকা খরচ না করে ফেলে রেখেছে। প্রশাসনিক বৈঠকের নামে বিশাল আয়োজনগুলিতে মুখ্যমন্ত্রী তাহলে এতদিন কীসের পর্যালোচনা করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরেরই হিসাব।
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের এই বিপুল পরিমাণ টাকা পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই পড়ে আছে। অর্থ কমিশন প্রতি বছর জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে টাকা দেয়। বেশি টাকা দেওয়া হয় গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে। বছরে দুই কিস্তিতে এই টাকা আসে। গত দু’ বছরের হিসাবেই তিনটি স্তরে পড়ে থাকা অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৯৪৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি অর্থ পড়ে আছে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে— প্রায় ১৭৪৫ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা।
রাজ্যের প্রতিটি জেলা পরিষদ তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েত সমিতিরও সেই হাল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে গায়ের জোরে পঞ্চায়েতগুলির প্রায় সবই কবজা করেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতী এবং চোররা। অর্থ কমিশনের টাকা খরচের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আগেই জানাতে হয়। কিন্তু প্রতি বছর টাকা খরচের জন্য পঞ্চায়েতের প্রতিটি পর্যায়ে বৈঠক করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হয়। বিশেষত পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে গ্রাম সংসদে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে কোন কোন কাজ হবে, তার পরিকল্পনা হওয়ার কথা। কিন্তু মমতা-শাসনে রাজ্যে গ্রাম সংসদের সভা প্রায় বন্ধ। যা হয়, তা মূলত তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সভা। ফলে টাকা খরচের বিশেষ কোনও পরিকল্পনা হয়নি। তা ছাড়াও তৃণমূলের পঞ্চায়েতগুলির কাজ এখন মূলত জমির দালাল আর কমিশনখোরদের মুঠিতে। অর্থ কমিশনের টাকায় গ্রামের ছোট রাস্তা, পুকুর, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজের মতো ক্ষেত্রে আদৌ তারা আগ্রহী নয়। ফলে অর্থ কমিশনের টাকায় কাজ হচ্ছে না।
অন্যদিকে জেলা পরিষদ এবং পঞ্চায়েত সমিতি চালান মূলত আমলারা। তাঁদের উপরেই সব কাজের দায়িত্ব। তাঁরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। অর্থ কমিশনের টাকায় জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে কাজও তাই অবহেলিত হয়েছে।
ফলে গ্রামের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা স্রেফ পড়ে থাকছে। হুঁশই নেই সরকারের। এর মধ্যে কিছু টাকা যে তৃণমূলীরা চুরি করেছে, এমন আশঙ্কাও গ্রামবাসীদের আছে!
কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকার একাংশ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে খরচ করা শুরু হয় দশম অর্থ কমিশনের সময়ে। অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে। এই টাকাকে ‘নিঃশর্ত তহবিল’ বলা হয়। বছরে দু’টি কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়। টাকার ২০ শতাংশ জেলা পরিষদ, ২০ শতাংশ পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৬০ শতাংশ টাকা গ্রাম পঞ্চায়েতকে দেওয়া হয়। তবে সব জেলা, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত একই হারে টাকা পায় না। মূলত জনসংখ্যা, আদিবাসী-তফসিলি মানুষের বসবাস, নিরক্ষরতার হার, পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য, বিদ্যুতের অবস্থা বিচার করে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেকেই কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন কিছু টাকা দেয়।
প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট সরকারও পঞ্চায়েতকে শক্তিশালী করার জন্য ২০০০-২০০১ সালে রাজ্য অর্থ কমিশন চালু করে। তৃণমূল সরকারের আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আর্থিকভাবে সবল করার এমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘‘এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি খতিয়ে দেখার কাজ চলছে। ফলে এই পড়ে থাকা টাকা কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকা।’’ কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকার দু’টি ভাগ থাকে— ‘টায়েড ফান্ড’ এবং ‘আনটায়েড ফান্ড।’ প্রথম তহবিলে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র বলে দেওয়া থাকে, যেখানে টাকা খরচ করা যায়। পরের তহবিলটিতে এমন নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বলা থাকে না।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের তৈরি হিসাব জানাচ্ছে, দু’টি তহবিলেই দু’বছরের দেদার টাকা পড়ে আছে। ২০২০-২১ সালে ‘আনটায়েড ফান্ড’-এর প্রায় ৩৬ শতাংশ খরচ করতে পারেনি রাজ্য। ‘টায়েড ফান্ড’-এ পড়েছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ টাকা। ২০২১-২২ সালে ‘আনটায়েড ফান্ড’-এর ১৪ শতাংশ এবং ‘টায়েড ফান্ড’-এর প্রায় ৩৬ শতাংশ টাকা খরচ হয়নি।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২০-২১ সালের টাকাও খরচ হয়নি পুরো। অর্থাৎ দু’বছর ধরে টাকা পড়ে আছে। পড়ে আছে প্রায় ১৮৬৪ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালের টাকাও পড়ে আছে। তার পরিমাণ ৮৭২ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। দু’বছর মিলিয়ে পড়ে আছে ২৯৪৩ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে পড়ে আছে সর্বাধিক— ১৭৪৫ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা।
দুই বছরের টাকা ফেলে রাখার তালিকায় সব জেলাই আছে। তার শীর্ষে মুর্শিদাবাদ। এই জেলায় পড়ে আছে প্রায় ২৯১ কোটি টাকা। তারপরই আছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ২০০৮ থেকে এই জেলা পরিষদ চালাচ্ছে তৃণমূল। এখানে পড়ে আছে প্রায় ২৭১ কোটি টাকা। ২০১৩-তে যে জেলা পরিষদে জয়ী না হওয়া সত্ত্বেও জোর করে দখল করেছিল মুখ্যমন্ত্রীর দল, সেই উত্তর ২৪ পরগনা এই অপদার্থতার তালিকায় তিন নম্বরে আছে। সেখানে পড়ে আছে প্রায় ২৪৩ কোটি টাকা। পশ্চিম মেদিনীপুরে পড়ে আছে প্রায় ১৯৮ কোটি টাকা। নদীয়াতেও প্রায় ১৯৮ কোটি টাকাই পড়ে আছে। মালদহে পড়ে আছে প্রায় ১৭৮ কোটি টাকা। পূর্ব মেদিনীপুরে পড়ে আছে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা। পুরুলিয়ায় পড়ে আছে ১২৭ কোটি টাকা। উত্তর দিনাজপুরে পড়ে আছে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। কোচবিহারে পড়ে আছে প্রায় ১১৭ কোটি টাকা। এমন প্রতিটি জেলাতেই বিপুল টাকা পড়ে আছে।
Village Development
গ্রামের উন্নতির ২৯৪৪ কোটি টাকা ফেলে রেখেছে রাজ্য
×
Comments :0