ন্যূনতম দর ৩ থেকে ৬ লক্ষ টাকা। মূলত গ্রামীণ এলাকার চাকরিপ্রার্থী যুবক-যুবতীরাই টার্গেট। শুধুমাত্র হুগলী জেলায় এমন ৩২৫জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ১৯ কোটি ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার তুলেছেন যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ। নিয়োগ কাণ্ডে ধৃত পার্থ চ্যাটার্জি ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যেরও ঘনিষ্ঠ হুগলীর বলাগড়ের বাসিন্দা এই যুব তৃণমূল নেতা।
বুধবার সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে সিবিআই দপ্তরে দাঁড়িয়েই সাংবাদিকদের কাছে এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সামনে আনলেন নিয়োগ কাণ্ডে ইডি’র চার্জশিটে মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেই অভিযুক্ত আরেক শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল। তাঁর দাবি তিনি সিবিআই-কে এই তথ্য দিয়েছেন। প্রথমদিকে সিবিআই ঐ যুব তৃণমূল নেতাকে জেরা না করলেও বুধবার তাঁকে তলব করে দীর্ঘ জেরা করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে যে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত রয়েছে শাসক তৃণমূলই, তারই আরেক কদর্য চেহারা ফের যেন সামনে এল।
কে এই কুন্তল ঘোষ? হুগলীর বলাগড়ের শ্রীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা। ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি থেকে তৃণমূলের যুব সভানেত্রী সায়নী ঘোষের সঙ্গে তাঁর একাধিক ছবিও দেখা গেছে সোশাল মিডিয়ায়। হুগলী জেলা তৃণমূলের সাংগঠনিক সভাপতি রুনা খাতুনেরও ঘনিষ্ঠ এই যুব নেতা। গত বছর ৩০ নভেম্বর তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নতুন কমিটি ঘোষণা হয়। মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায় এবং অভিভাবকত্বে এই নতুন কমিটি বলেও ঘোষণা করা হয়। সেই নতুন কমিটিতেই রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কুন্তল ঘোষের নাম ঘোষণা করা হয়।
শুধু হুগলী জেলা নয়, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদ একাধিক বিএড, ডিএলএড কলেজে, ফার্মসিউটিক্যাল ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর্ণধার। কার্যত যেন শিক্ষা ব্যবসায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা।
বলাগড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদেরই অভিযোগ গত চার পাঁচ বছর ধরে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে এলাকা থেকে বিপুল টাকা তুলেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছেও সেই অভিযোগ জমা পড়েছিল। যদিও তারপরেও এই নেতার দাপট আরও বাড়ে। কয়েক মাস আগেই হুগলী জেলার পুলিশ সুপারের কাছে পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনও করেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা। তাঁর বাড়ির সামনে সিভিক ভলান্টিয়ারের ডিউটি থাকে, নিরাপত্তার জন্য। অভিষেক ব্যানার্জি থেকে সায়নী ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা জানে গোটা হুগলী জেলা। ফলে পুলিশ প্রশাসনও তটস্থ থাকে।
অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নাম করে রীতিমত টাকা তুলে তার ভাগ এবং চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা সরাসরি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পাঠানো হতো। মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জিরও ঘনিষ্ঠ ছিল এই ব্যক্তি। প্রাইমারির লিস্ট হুগলী জেলা থেকে তাঁর মাধ্যমেই যেত। টাকার একটা অংশ মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির কাছেও যেত। এছাড়াও শাসক তৃণমূলের আরো শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছাতো টাকার ভাগ।
বুধবার সিবিআই জেরা শেষে বাইরে বেরিয়ে শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘আমার কিছু পরিচিত ছাত্র-ছাত্রী একজনকে টাকা দেয় চাকরির জন্য। সেই নামটি আমি ইডি-কেও বলেছিলাম। তার নাম কুন্তল ঘোষ। আজ দেখলাম তাকে ডেকেছিল সিবিআই। হুগলীর যুব তৃণমূল নেতা। আমার হিসাব অনুযায়ী ১৯ কোটি ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো টাকা তুলেছিল। সিবিআই জেরায় নাকি স্বীকারও করেছে টাকা তোলার কথা। তবে যারা আমাকে বলেছিল তাদের ধরে আমার হিসাব এটা। আমার জানার বাইরেও প্রচুর টাকা তুলেছিল চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে। আমি মাত্র ১৯ কোটির তথ্য পেয়েছি। আরও টাকার খেলা আছে। প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো।’
বলাগড় এলাকায় একাধিক চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন এই কুন্তল ঘোষ। যদিও অনেকে চাকরি পায়নি টাকা দেওয়ার পরেও। গোটা হুগলী জেলায় এই জাল ছড়িয়েছিল। সিবিআই’র একটি সূত্রে জানা গেছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা তুলেছিল। সিংহভাগই নগদে লেনদেন হয়েছিল। বিপুল টাকার একটা বড় অংশ শাসক তৃণমূলের নির্দিষ্ট মহলেও পৌঁছেছিল। তাই কি চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা তোলার পরেও এমন প্রতারককে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়ে দেওয়া হয়?
এর আগেও অভিষেক ব্যানার্জি যাঁকে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়েছিলেন ২০১৯ সালে সেই বিনয় মিশ্র কয়লা পাচার কাণ্ডে এখনও ফেরার, ভিন দেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস পর্যন্ত জারি হয়েছে। কার্যত প্রতারকদেরই যেন বেছে বেছে জায়গা দেওয়া হয় যুব তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে।
গত ৭ ডিসেম্বর নিয়োগ কাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের করেছিল ইডি। প্রায় ১৫০ পাতার চার্জশিটে নিয়োগ কেলেঙ্কারির কিংপিন মানিক ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডলের নাম ছিল। ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেটে ৩২৫জন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়েছিলেন মানিক ভট্টাচার্য।
অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স সংস্থার নামও বারেবারে আসে এই নিয়োগ দুর্নীতিতে। এই সংস্থা মূলত শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে। আগে এর সভাপতি ছিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা নলহাটি-২নম্বর ব্লকের সভাপতি বিভাস অধিকারী। পরবর্তীতে মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাপস মণ্ডলকে সভাপতি পদে বসানো হয়। গোটা রাজ্যে তাঁর বিএড, ডিএলএড সহ প্রায় কুড়িটি কলেজ, স্কুল রয়েছে। মহিষবাথানে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা চালান তাপস মণ্ডল। ইডি, সিবিআই মিলে এখনও পর্যন্ত সাত দফায় জেরার মুখে পড়েছেন এই ব্যক্তি। এর আগে তাপস মণ্ডল স্বীকার করেছিলেন মহিষবাথানে তাঁর অফিস থেকে মানিক ভট্টাচার্যকে ছাত্র পিছু টাকা পাঠানো হতো নিয়ম করেই।
এই তাপস মণ্ডলের সঙ্গেই শিক্ষা ব্যবসায় হাত পাকিয়েছিলেন কুন্তল ঘোষ। তাপস মণ্ডলের সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়েও এদিন নিজাম প্যালেসে জেরা করা হয় তাঁকে।
Comments :0