স্বর্ণেন্দু দত্ত: আগরতলা
সকাল সাড়ে পাঁচটায় মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে রামনগরে ভোট দিতে বেরিয়ে ছিলেন লিটন মিয়া। রাস্তায় আটকায় বিজেপি প্রার্থী সুরজিৎ দত্তর বাহিনী। যেতে বাধা পেয়ে তাঁর মেয়ে হেলপ লাইনে ফোন করতে গেলে দুষ্কৃতীরা তার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। বাধ্য হয়ে পাড়ায় ফিরে আসেন তাঁরা।
এইরকম গত লোকসভা আর পৌরসভা ভোটে হয়েছিল। তফাতটা হয় এরপরে। পাড়ায় এসে এই ঘটনা জানানোর পরে গোটা পাড়া থেকে সাড়ে তিনশো মানুষ একসঙ্গে রওনা দেন ভোট কেন্দ্রে। পিছু হটে দুর্বৃত্তরা। ত্রিপুরায় গোটা দিন এই প্রতিরোধের ছবিই দেখেছেন মানুষ। ভোট দেওয়ার তাগিদে, প্রতিরোধের জেদে দিনের শেষে ভোট শতাংশের হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বিকেল চারটের সময়ে ভোট প্রদানের হার ছিল ৮১ শতাংশ। কিন্তু কমিশন জানিয়েছে, তারপরেও লাইনে লক্ষাধিক মানুষ আছেন। এর সঙ্গে পোস্টাল ব্যালট যোগ করলে ৯২ শতাংশ পেরিয়ে যাবে। যা গতবারের ৮৯ শতাংশের থেকে বেশি।
উদয়পুরের কাকড়াবন-শালগড়া কেন্দ্রে এদিন শালগড়ায় ভোটারদের উপরে হামলা করে বিজেপি দুষ্কৃতীরা। লাঠি, রড নিয়ে ভোটারদের উপরে বেপরোয়া হামলা হয়। ৩০জনের বেশি জখম হন। এদের মধ্যে সিপিআই (এম) কর্মী অমিত ভৌমিক এবং রফিকুল ইসলামের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপরেও বাকিরা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ভোট দিতে যান। আহত, জখম অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন।
আগরতলার উপকণ্ঠে চড়িলাম কেন্দ্রে প্রার্থী উপমুখ্যমন্ত্রী যিষ্ণু দেববর্মা। সেখানে তীব্র সন্ত্রাস। ভোটপ্রচারের সময়েও চলেছে তীব্র সন্ত্রাস। সেই চড়িলামেই তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধের বীরগাঁথা। গৌতম কলোনি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ভোটার অভিজিৎ দাস। সকালে ভোট দিতে গেলে বিজেপি দুর্বৃত্তরা তাঁকে তাড়িয়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন নিজ পাড়ায়। এসে দেখেন তাঁর মতো ৩১ জন ভোটারকে এইভাবে তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। তিনি ঐসব ভোটারকে একত্রিত করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ভোটার হেল্প লাইনে ফোন করেন। কিছুক্ষণ পরে সিআরপিএফ নিয়ে ঐ স্থানে গিয়ে পৌঁছান এক নির্বাচনী আধিকারিক।
ভোটারদের এসকর্ট করে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
ধনপুরের ভবানীপুর স্কুলে ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেয় বিজেপি দুর্বৃত্তরা। প্রতিবাদে দলবদ্ধভাবে সেখানেই রাস্তা আটকে অবরোধে বসে পড়েন মানুষ। এরপরে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপে তাঁরা ভোট দেন। খয়েরপুর, বিলোনিয়া, মজলিশপুর, মান্দাই সহ বিভিন্ন কেন্দ্রে এইভাবেই দিনভর প্রতিরোধ গড়েছেন মানুষ।
প্রতিরোধের মুখে পড়ে বেপরোয়া হয়ে বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়েছে বিজেপি। মজলিসপুরে সিপিআই (এম)’র পোলিং এজেন্ট আলি আসগরকে মারধর করে বুথ দখলের চেষ্টা হয়। খয়েরপুর বিধানসভায় ভোট লুট করতে না পেরে ভোট শেষে দুই পোলিং এজেন্ট মীনাক্ষী কর এবং দীপঙ্কর দত্তর উপরে হামলা করে। মীনাক্ষী করকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। এখানের বিজেপি প্রার্থী রতন চক্রবর্তী বুথে বুথে ঘুরে হামলার নেতৃত্ব দেন। যদিও প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। মান্দাই বিধানসভা কেন্দ্রে দুর্গানগরে হামলা চালায় বিজেপি। দুই পোলিং এজেন্টকে মারধর করে। শান্তিরবাজার কেন্দ্রে ৫৭ নম্বর বুথে ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে ভোটারদের বেধড়ক মারধর করে বিজেপি দুষ্কৃতীরা। ঋষ্যমুখ কেন্দ্রে সিপিআই (এম) কর্মীদের উপর আক্রমণ করে বিজেপি দুষ্কৃতীরা। পালটা প্রতিরোধে জখম হয়ে তিন বিজেপি কর্মী হাসপাতালে।
এদিন ভোট শেষে সিপিআই (এম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এক বিবৃতিতে বলেছে, রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী এক তেজোদীপ্ত দৃঢ়পণ বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রদর্শন করে গণতন্ত্র, শান্তি-সম্প্রীতি, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রকৃতই নিজেদের এক অনন্য ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই অসাধারণ লড়াইয়ে প্রকৃতপক্ষে ত্রিপুরার সাহসী নির্বাচকমণ্ডলীই জয়ী হয়েছেন। শাসক বিজেপি’র সমস্ত ষড়যন্ত্র, ভয়ভীতি, প্রতিবন্ধকতা এবং দৈহিক আক্রমণ ও স্থানে স্থানে আক্রমণ প্রতিহত করে যেভাবে এগিয়ে এসে স্বাধীনভাবে নিজেদের ভোট দেবার মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন তা ত্রিপুরার বুকে এক ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছে। দেশের সামনেও এ এক দৃষ্টান্ত। সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে ত্রিপুরার বাহাদুর নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি আন্তরিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিনহা বলেছেন, আমরা মানুষের কাছে যে আবেদন জানিয়ে ছিলাম সেটাই এদিন প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষ সাহসের সঙ্গে ভোট দিয়েছেন। রাজ্যে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের সরকার হবে। তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোৎ কিশোর বলেছেন, ভোট মোটের উপর সুষ্ঠু ছিল। বিজেপি চেষ্টা করেছিল লুট করতে, কিন্তু পারেনি। তিনি দাবি করেন, ৩৩ আসন নিয়ে তারাই সরকার গঠন করছেন।
বিজেপি’র পক্ষ থেকে এদিন রাজ্য সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য বলেন, আরক্ষা দপ্তরের ভূমিকার জন্য আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অভিনন্দন জানাচ্ছি নির্বাচন কমিশনকে। কেন্দ্রীয় বাহিনী সহ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় আমরা সহমত প্রকাশ করছি। সংবাদ মাধ্যম সহ জনগণকেও অভিনন্দন জানিয়েছে বিজেপি।
এদিকে বিভিন্ন জায়গায় এদিন সকাল থেকে অতি ধীর গতিতে ভোট হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে ভোট কর্মীদের একাংশকে বিজেপি ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিচ্ছে কি না, যাতে মানুষ অধৈর্য হয়ে ঘরে ফিরে যান। কিন্তু দেখা যায়, সকাল ১১টায় এসে সন্ধ্যা ছটার সময়ে ভোট দিতে পেরেছেন, তবুও লাইন ছেড়ে যাননি মানুষ। এই বিষয়েও বিবৃতিতে সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বলেছে, এবারের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক সময় লেগে গেছে। ভোটদাতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বিকাল চারটায় ভোট শেষ হবার কথা। কিন্তু এখনও রাত ন’টার পরেও রাজ্যের বহু স্থানে ভোটদাতাদের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেবার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এটা বাঞ্ছনীয় ছিল না।
ত্রিপুরায় এই ভোট-চিত্র দেখে নির্বাচন কমিশনও দাবি করেছে, তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় বড় কোনও হিংসার ঘটনা ছাড়াই ভোট হয়েছে।
Comments :0