প্রতীম দে
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সকাল ন’টা নাগাদ পাড়ার মোড়ে অফিসের গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকত সেই যুবতী। গত কয়েকদিন তাঁকে আর বেরতে দেখা যাচ্ছে না। জানা গিয়েছে, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে যে তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতেন তিনি, সেই কাজ আর নেই।
তথ্য প্রযুক্তিতে ছাঁটাই কেন?
তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ছাঁটাই চলছে বিশ্বজুড়ে। গুগল জানিয়েছে ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত। তার আগেই বিশ্বজোড়া নাম মাইক্রোসফ্ট, টুইটার, আমাজন হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে।
উইপ্রো, ইনফোসিসের মতো দেশের ‘টেক জায়েন্ট’-রা কর্মী ছাঁটাই করছে। তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর পরিষেবা প্ল্যাটফর্মেও চলছে ছাঁটাই।
কিন্তু কেন চলছে এই ছাঁটাই?
সব সংস্থাই অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাত দিচ্ছে। অথচ করোনা মহামারীর সময় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা গুলি বিপুল অঙ্কে আয় করেছে। কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক দেবেশ দাসের বক্তব্য, সঙ্কট রয়েছে। মন্দার প্রভাব আছে। কিন্তু মুনাফার মাত্রা উঁচু স্তরে রাখার লোভও আছে। সে কারণে ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলি।
রাজ্যের এই প্রাক্তন মন্ত্রী বলছেন, ‘‘করোনার সময় থেকে ওয়ার্ক ফর্ম হোম শুরু হয়েছে। তা এখনও চলছে। যার ফলে পরিকাঠামোর দিক থেকে সংস্থাগুলিকে কোনও ব্যয় করতে হচ্ছে না। বড় সংস্থাগুলি ল্যাপটপ দিলেও ছোট সংস্থাগুলি তাও দিচ্ছে না।’’
বিশেষজ্ঞদের মত, সঙ্কটের মধ্যে অতি মুনাফার মাত্রা যাতে না কমে সে কারণেই চলছে ছাঁটাই। বিভিন্ন দেশেই সরকারি স্তরে উদাসীনতা রয়েছে। ফলে ছাঁটাই সহজ পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখার্জি বলছেন, ‘‘কলকাতায় যে সব তথ্য প্রযুক্তির অফিস আমরা দেখি সেগুলি বেশিরভাগই কোনও না কোনও বড় সংস্থার ‘ব্যাক অফিস’। বহুজাতিক সংস্থার পাঠানো কাজ করে এরা। এদের নিজস্ব বাজার নেই। যার ফলে বাইরের মন্দার প্রভাব আমাদের এখানে এসে পড়ছে।’’
দেবেশ দাস বলছেন, ‘‘ছাঁটাইয়ের খাঁড়া ঝুলিয়ে রেখে চলছে বিপুল মাত্রায় শোষণ। অফিসে গিয়ে কাজ করলে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কিন্তু বাড়িতে কাজের ক্ষেত্রে প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু সমানুপাতে বেতন পাচ্ছেন না তথ্য প্রযুক্তি কর্মীরা। তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলি চাইছে কম লোক দিয়ে কাজ করাতে।’’
অধ্যাপক দাসের মতো একই কথা শোনা গিয়েছে অধ্যাপিকা মুখার্জির কাছেও। অধ্যাপিকা মুখার্জি বলেন, ‘‘তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি আটকানো যাবে না। সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন বিভিন্ন ‘কোড’ তৈরি হয়েছে। তাতে কাজের সুবিধা হচ্ছে আগের তুলনায়। লোকও কম লাগছে। যে কারণে কোডার, ডেভেলপারদের সংখ্যা খুব ধীরে ধীরে হলেও কমছে।’’
গোটা বিশ্ব জুড়ে যেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে আর তার প্রভাব যে তথ্য প্রযুক্তির ওপর পড়েছে তা মেনে নিয়েছেন দুই অধ্যাপক। দেবেশ দাস বলেন, ‘‘এই বিষয় কোনও সন্দেহ নেই যে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটা মন্দার প্রভাব পড়েছে।’’ মুখার্জি বলেন, ‘‘করোনার প্রভাব এবং অর্থনৈতিক মন্দা, দুটোর প্রভাব পড়েছে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে কোনও মন্দা হবে না এটা ভাবা সম্পূর্ণ ভুল।’’
ভারতে সরকারি স্তরে উদাসীনতা
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথ্য প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু আইন রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র কথা মুখে বলেও তথ্য প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য কোনও আইন তৈরি করেনি সরকার। যার ফলে যে কোন সময় ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি কর্মীদের।
নন্দিনী মুখার্জির কথায়, ‘‘নির্দিষ্ট কোনও আইন না থাকায় একজন তথ্য প্রযুক্তি কর্মীকে দিনে প্রায় ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হচ্ছে। মহিলা কর্মীদের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন কোনও ছুটি নেই। এই সব বিষয় নিয়ে আইটি কর্মীরা বার বার সরব হয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’’
মুখার্জি আরও বলেন, ‘‘অন্যান্য দেশে আইটি আইন অত্যন্ত কঠোর হওয়ায় সেখানে নাগরিকদের তথ্য সুরক্ষিত, কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই।’’
ভারতে কোনও কঠোর তথ্য প্রযুক্তি আইন না থাকায় যেকোন সময় হ্যাকিং বা তথ্য চুরি করা সহজেই সম্ভব। এই সব বিষয় নিয়ে তথ্য প্রযুক্তির সাথে যুক্ত বিশেষঞ্জরা সরব হলেও সরকার কিছু করেনি। উল্টে কেউ যদি নিজের ফেসবুক বা অন্য কোন সামাজিকমাধ্যমে সরকার বিরোধী কোন পোস্ট যদি করে থাকে তবে তাকে গ্রেপ্তার করে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিতে ব্যস্ত। আর এই আইনের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের মতো করে ভ্রান্ত খবর ছড়িয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছে আরএসএস এবং বিজেপির আইটি সেল।
ডেটা প্যাকের খরচ
২০১৪’র নির্বাচনের আগে একাধিক স্মার্ট সিটি, ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার স্বপ্ন দেখান নরেন্দ্র মোদী নিজে। তারপর নয়া শিক্ষা নীতির মোড়কে বাজারে আসে অনলাইন এডুকেশন। কিন্তু এই সবের জন্য যেই ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা তা হলো ‘ডেটা’। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। ২০২২ সালের শুরুতে যেই ডেটা প্যাকের দাম ছিল ১৪৯ টাকা এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা। জিও। যার ভরসায় নরেন্দ্র মোদী ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তোলে সেই জিও গত একবছরে বাড়িয়েছে ডেটা প্যাকের দাম। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোন আইন যেমন নেই, তেমন নেই কোন সরকারি উদ্যোগও।
ডেটা প্যাকের দাম বাড়ার কারণে অনেক ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের লেখা পড়া চালাতে পারেনি। অধ্যাপিকা মুখার্জি এই বিষয় নিজের একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘‘সরকার অনলাইন শিক্ষাকে উৎসাহিত করছে। ক্লাসঘরে পড়ানোর ব্যবস্থা তুলে দিতে চাইছে। যার বিরোধিতা আমরা করছি। এই অনলাইন এডুকেশনের ফলে অনেকে নিজেদের লেখা পড়া চালাতে পারেনি। বহুবার দেখেছি ক্লাস করতে করতে অনেক পড়ুয়া বেরিয়ে গিয়েছে। পরে তাদের জিজ্ঞাসা করলে জেনেছি ডেটা না থাকায় তারা ক্লাস করতে পারেনি।’’
Comments :0