মীনাক্ষী মুখার্জি
২৮ মার্চ বেকারি বিরোধী দিবস। ৫৩ বছর আগে ১৯৭৩ সালে ২৮টি গণসংগঠন মিলে বেকারি দূর করার জন্য এই দিনটিকে বেকারি বিরোধী দিবস হিসেবে প্রথম পালন করে। তখন আমাদের সংগঠনের নাম ছিল ডিওয়াইএফ। সেই সময় যারা দিল্লির সরকারে ছিলেন তাঁরা বাজেটে বেকারদের কাজ দেওয়ার কথা বলেন। তখন তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দেশের প্রতি জেলায় অন্তত ১ হাজার ব্যক্তিকে ১০মাসের জন্য কাজ দেওয়া হবে, প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে উপার্জনের গ্যারান্টি থাকবে। সেই অনুযায়ী বরাদ্দ করার কথা ছিল ১০০ কোটি টাকা, কিন্তু বরাদ্দ করা হয় মাত্র ৩ কোটি টাকা। কাজের অভাবে পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর বেকার ছিল। সক্ষম হাতে কাজ না থাকায় কাজের দাবী সামাজিকভাবেই একটি মৌলিক দাবিতে পরিণত হয়েছিল। যুব সম্প্রদায় থেকে উন্নীত হয়ে কাজের দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়।
১৯৭২ সালের ২৬ নভেম্বর ২৮টি গণসংগঠনের ডাকে সুবিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় শহীদ মিনার ময়দানে। সেখানে যুবরা দাবী তোলেন, ‘হয় কাজ দাও, না পারলে বেকার ভাতা দিতে হবে।’ এরপর রাজ্য কনভেনশনের ডাক দেন যুবরা। ৭৩ সালের ২৮ মার্চ বিক্ষোভ হয়, গণঅবস্থান হয়। এভাবেই বেকারি বিরোধী দিবসের সূচনা।
এই আয়োজনে কে ছিলেন না? ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা সহ সব অংশের বামপন্থীরা ছিলেন। তারপর ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা সরকার গড়লেন। এরপর পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যের স্বয়ম্ভর হবার সাথে সাথে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়তে থাকল। জীবনের প্রয়োজনে বাজারে মানুষের বেশ কিছু জিনিস কেনার ক্ষমতা বাড়ল। ফলে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বাজার বিকশিত হলো।
আমরা সবাই জানি ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কীভাবে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, হলদিয়া পেট্রো কেমিক্যাল, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ গড়ে উঠেছিল। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে অর্থাৎ এমএসএমই-তে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর পাশাপাশি সড়ক, বিদ্যুৎ, জলের ব্যবস্থা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের ফলে সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হলো।
শুরুতে ভূমি সংস্কার হওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিকশিত হলো। সঙ্গে এখানকার মানুষের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য, ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, তাকে স্বীকৃতি দান করা, তাদের ঐতিহ্যকে মর্যাদা দেওয়া, মানুষের চেতনা বৃদ্ধি হওয়া, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়া এবং শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর্ব চলতে লাগল। এরই সঙ্গে স্কুল, কলেজ, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বাড়তে থাকল। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই স্কুল কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলো। এককথায় রাজ্যের সার্বিক বিকাশের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। এই সময়েই ছাত্র-যুবরা রক্ত বিক্রি করে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। উত্তরে দার্জিলিঙ জেলার সোনাদায় ঘড়ি অ্যা সেম্বেলের একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাগরাকোটে একটি রুগ্ণ কয়লা খনি ছিল। তার পুনরুজ্জীবনের জন্য বামপন্থী যুবরা লড়াই করেছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে উত্তরের জেলাগুলিতে বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা তৈরি হয়েছিল। যেমন হলদিবাড়ি, মেখলিগঞ্জে লঙ্কা টমেটো, মালদার আম, বিধাননগরে পাইনঅ্যাপেল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, চোপড়া, ইসলামপুর ইত্যাদি জায়গায় আনারস প্রভৃতি নিয়ে বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট গড়ে উঠেছিল। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করা, খাদ্যে সয়ম্ভর হওয়ার সাথে সাথে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ১০ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে এসে বাগডোগরার কাছে কারগো সেন্টার তৈরি হয়েছিল। কালিম্পঙে অর্কিড ফুল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশের সাহায্যে টি পার্ক তৈরি হয়েছিল। একটি স্থল বন্দরও তৈরি হয়েছিল। তথ্য প্রযুক্তি শিল্প বিকাশের জন্য একটি দশতলা ভবনের পরিকাঠামো তৈরি, ২৫ একর জমিতে এসইজেড তৈরি করে তথ্য প্রযুক্তি পার্ক তৈরির পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়ে প্রায় সমস্ত কিছু বন্ধ। প্রকল্পের জমি লুট হচ্ছে। বর্তমান সরকারের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। রাজ্যে সরকারের পালা বদলের সাথে সাথে উত্তরবঙ্গে বিগত সরকারের প্রায় সমস্ত প্রকল্প বন্ধের মুখে। দিল্লিতে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করতে চাইছে। আরএসএস-এর ব্রেইন চাইল্ড তৃণমূল কংগ্রেস দল পশ্চিমবঙ্গ চালাচ্ছে। এই দলটি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, তোলাবাজ, সিন্ডিকেট রাজ, দুষ্কৃতীরাজ তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গে।
আজ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের পর গ্রাম পুরুষ শূন্য। কারণ রাজ্যে কাজ নেই। অথচ বামপন্থী যুবদের দাবীকে মান্যতা দিয়েই কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম অনুযায়ী বামপন্থী সাংসদদের দাবীর ফলেই প্রথম ইউপিএ সরকার ১০০ দিনের কাজকে মৌলিক অধিকারে পরিণত করে। আর এখন আমরা দেখছি রাজ্যের বর্তমান সরকার ১০০ দিনের কাজ নিয়ে চরম দুর্নীতি করছে। ফলে এই অজুহাতে কেন্দ্র ১০০ দিনের মজুরির টাকা দিচ্ছে না। কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকারের চরম ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ভূমিকার জন্য গ্রামের মানুষ ১০০ দিনের কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ করেও মজুরি পাননি বহু প্রন্তিক মানুষ। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, কৃষিতে কর্মসংস্থান নেই। সাথে রাসায়নিক সারের কালোবাজারি, বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল, সরকারের ভর্তুকিহীন ফসল উৎপাদনের খরচ এবং ফসল বিক্রি করে যা আয়, তাতে কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ফলে কৃষক জমি রাখতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ-কোটি বেকার। গত ৮ বছরে ২২২৭টি কোম্পানি তাদের নথিভুক্ত অফিস আমাদের রাজ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য রাজ্যে। তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬-২০২১ পর্যন্ত ২১ হাজার ৫২১ টি ছোট, মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়েছে। অথচ আটটি বিশ্ব শিল্প সম্মেলন করে ফেলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
এক বছর আগে বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যের শ্রম বমন্ত্রী জানিয়েছিলেন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২১,৫৯,৭৭৩। অথচ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ছুঁয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট এই বিষয়ে রাজ্য সরকারকে হলফনামা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ সরকারের কাছে গত ১২ বছরের নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। বিভিন্ন বেসরকারি রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রাজ্যের এমন কোনও জেলা নেই যেখানে পরিযায়ী শ্রমিক নেই। মালদা, মুর্শিদাবাদের অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক । উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তরের চা বাগান - সর্বত্র সঙ্কট। এদের কাজের এবং মজুরির সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা কিছুই নেই। নেই ন্যূনতম মজুরি। পারিযায়ী শ্রমিকরা তাদের মজুরির একটা অংশ পরিবার প্রতিপালনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে পাঠায়। রাজ্যস্তরে অর্থনীতিতে এই অর্থের জোগান গুরুত্বপূর্ণ, সরকার রাজস্ব আয় করছে। কিন্তু সরকার এদের প্রতি কোনও দায়িত্ব স্বীকার করছে না। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সরকারের কাছে কোনও তথ্য পর্যন্ত নেই। ঠিকা শ্রমিকদের অবস্থা আরও খারাপ। ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় ছিল, স্থায়ী এবং নিয়মিত কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। ১৯৭০ সালের ঠিকা শ্রমিক (নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ ) আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঠিকা প্রথায় নিয়োগ চলেছে। পুলিশ, হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে এখন শিক্ষকদেরও ঠিকা প্রথায় নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে। এখন শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্র নয়, সারা ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিক বাড়ছে হু হু করে। ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিক ছিল ৩৭ শতাংশ। এদের মজুরি, নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের কোনও চিন্তা নেই। তাহলে সুপ্রিম কোর্ট কি শুধুই সংবিধানের ব্যাখ্যা করেই সন্তুষ্ট থাকবে?
রাজ্যে কাজ না থাকায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে রাজ্যে সামাজিক ও নৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। গত তিন বছরে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে ৩৭৯০টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এবং ১ হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুলের দরজা বন্ধ হয়েছে।
রাজ্যজুড়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন। চা বাগান থেকে পাচার হচ্ছে নাবালিকা। মালদা থেকে আলিপুরদুয়ার শাসক দলের মদতে চলছে রেপ কালচার। বাড়ছে বাল্য বিবাহ। গত ২০২৪ সাল, এক বছরে দক্ষিণ দিনাজপুরে বাল্য বিবাহ হয়েছে ৭ হাজার। অন্তঃসত্ত্বা গর্ভবতী হয়েছে সাড়ে চার হাজার নাবালিকা। স্বাস্থ্যে বেহাল দশা। সরকারি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে অস্ত্রপচারের ব্যবস্থা নেই, ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতালে ভুয়ো ওষুধ, জাল স্যালাইনে মরছে গর্ভবতী প্রসূতি মা। স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োগ নেই, আছে শুধু থ্রেট কালচার।
নতুন কোনও কলেজ নেই, স্কুল নেই। শাসকের মদতে বাড়ছে উগ্র ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেকারের হাতে কাজ নেই। কাজের বদলে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করছে শাসক ও প্রধান বিরোধী দল। মালদা সহ একাধিক জেলায় নদী ভাঙন। চাষের জমি, বসত ভিটে গ্রাস করছে নদী। সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু নদী ভাঙন রোধে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন বিভাগ বা রাজ্য সরকার কারোরই কোনও হেলদোল নেই। ধর্মীয় বিভাজনের সুযোগ নিয়ে অবাধে লুট হচ্ছে গরীব মানুষের পাট্টার জমি, নদীর পাথর বালি, জঙ্গলের গাছ–কাঠ, প্রাকৃতিক সম্পদ, সরকারি জমি। জমি মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি।
২৮শে মার্চ বেকারি বিরোধী দিবস। রাজ্য থেকে, দেশ থেকে বেকারত্ব দূর করার জানকবুল লড়াই লড়ছে আমাদের সংগঠন। আমাদের লক্ষ্য, কেউ যেন কাজ না পেয়ে পরিযায়ী হয়ে রাজ্যের বাইরে চলে না যায়। রাজ্যেই চাই বেকারের স্থায়ী কর্মসংস্থান। আরও একটি লড়াই উত্তরকন্যা চলো। এই লড়াই সবার বাঁচার লড়াই। স্থায়ী কাজ পাবার লড়াই, বিভাজন দূর করার লড়াই। দুর্নীতিরাজ, দুষ্কৃতীরাজ, দাঙ্গাবাজী, লুটের রাজ খতম করার লড়াই। ২৮ মার্চ বেকারি বিরোধী দিবসে গোটা রাজ্য উত্তাল হবে স্থায়ী কাজের দাবীতে, বেকারত্ব দূর করার দাবীতে। উত্তরকন্যা থেকে বার্নপুর ইস্কো কারখানার গেট, কোচবিহার থেকে ঝাড়গ্রাম - ভুল অ্যা জেন্ডার বিরুদ্ধে মূল অ্যা জেন্ডায় আমরা, যুব সম্প্রদায় থাকব রাস্তায়।
Comments :0