Canteen

স্মৃতির স্মরণিতে অজেয় ক্যান্টিনের দিনযাপন

ফিচার পাতা

প্রতীম দে

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জুড়ে ছিল ‘রাখালদা-র ক্যান্টিন’। 
প্রেসিডেন্সি মানে প্রমোদ দা’র ক্যান্টিন। যাদবপুর মানে মিলন দা’র ক্যান্টিন।
রাখাল চন্দ্র ঘোষ। প্রমোদ সাঁই। মিলন দে। তিনটে নাম। মিল একটা জায়গায়। তাঁরা প্রত্যেকেই শহরের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বহু প্রজন্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ক্যান্টিন মালিক থেকে হয়ে উঠেছেন কাছের মানুষ। কিন্তু সেইসব এখন অতীত। ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে ‘রাখাল দা’র ক্যান্টিন’ এবং ‘প্রমোদ দা’র ক্যান্টিন’। একটা সময় বহু রাজনৈতিক চর্চা, প্রেমের সাক্ষী থাকা চেয়ার টেবিলগুলো আজ আর নেই। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে —‘ক্যাফে’। 


রাখাল দা হোক বা অন্য কেউ এনাদের সবার ইউএসপি হচ্ছে কম দামে ভালো খাবার। এককথায়, খাবারের দাম থাকতো ছাত্র-ছাত্রীদের সাধ্যের মধ্যে। 
কটক থেকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে কলকাতায় আসেন প্রমোদ সাঁই। প্রথমে এক আত্মীয়র বাড়িতে ওঠেন। তারপর তাঁর ঠিকানা হয় প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাস। সেই সময় ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি জানতেন না যে একটা সময় ওই সাদা বাড়ির ‘অঙ্গ’ হয়ে উঠবেন তিনি। চার দশকে প্রেসিডেন্সির বহু ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক হয়ে ওঠেন তিনি। হয়ে ওঠেন ‘প্রমোদ দা’। ২০১৭ সালে সেই প্রমোদ দাকে যখন প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিন ছাড়তে বলে তখন এক আলাদা আন্দোলন দেখেছিল কলেজ স্ট্রিট। ক্যান্টিন বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছিলেন অনেক প্রাক্তনী এবং পড়ুয়ারা। কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল তাঁর প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নেই, বাকি রয়েছে টাকা। ‘কাছের মানুষকে’ ক্যাম্পাসে রাখতে নিজেদের উদ্যোগে টাকা তুলে বকেয়া টাকা মেটায় প্রাক্তনীরা। কিন্তু নতুন করে ক্যান্টিন তৈরি করতে আর রাজি হননি প্রমোদ দা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর তার আর জায়গা নেই। ব্যবসা করতে গেলে তাকে করতে হবে বাইরে। প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্র করেই প্রমোদ দা’র জীবন। তাই ক্যাম্পাসের বাইরে আর নতুন করে ব্যবসা শুরু না করে কটক ফিরে গিয়েছেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাবেরি চক্রবর্তী। ছাত্র জীবনে প্রেসিডেন্সিতে পড়ার কারণে প্রমোদ দা’র ক্যান্টিনে যেমন সময় কাটিয়েছেন তেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাখাল দা’র ক্যান্টিনেও সময় তিনি কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাখাল দা, প্রমোদ দা’দের সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আমাদের। ক্যান্টিনে বসে পোস্টার লেখা আড্ডা দেওয়া সব কিছুই চলতো। আবার বেশি জোরে কথা হলে কাউকে নিয়ে বেশি মজা করলে বকাও খেতাম রাখাল দা’র কাছে।’’ এখানেই শেষ নয়। প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীর সাথে তাঁদের ছিল ‘তুই’ বা ‘তুমি’র সম্পর্ক। অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কলেজে কোনও ঝামেলা হলে প্রমোদ দা’র কাছে বই ব্যাগ রেখে বাড়ি চলে আসতাম। তিনি সব কিছু গুছিয়ে রাখতেন। কোনোদিন যদি না যেতাম তাহলে খবর নিতেন যে কেন আসিনি। কে কোথায় গিয়েছে, কে কবে আসেনি সব তাঁর নখদর্পণে থাকতো।’’ 


৯০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব তরুণ ব্যানার্জি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসাবে দীর্ঘ সময় তিনি কাটিয়েছেন রাখাল দা’র ক্যান্টিনে। তিনি বলেন, ‘‘রাখাল দা এমন একজন মানুষ যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু , অনিল বিশ্বাসদের নাম ধরে ডাকতেন। আবার সুব্রত মুখার্জি, প্রিয়রজ্ঞন দাসমুন্সিদেরও তিনি নাম ধরে ডাকতেন। বহু প্রজন্ম রাখাল দা’র স্নেহে বড় হয়েছে। হাসি মুখে ছাত্রদের বহু আবদার মিটিয়েছেন তিনি। আবার বকাও দিয়েছেন। কিন্তু কখনও কোনও সময়ের জন্য কারুর ওপর তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেননি।’’ 
৮০’র দশক ৯০’র দশকে বহু ছাত্র সংঘর্ষের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কাছে আক্রান্ত হয়েছেন এসএফআই কর্মীরা। ভাঙা হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই পরিচালিত ইউনিয়ন রুম। সেই সময় রাখাল দা আগলে রেখেছে ছাত্রদের। তরুণ ব্যানার্জির স্মৃতিতে সেই সব কথা এখনও টাটকা। ব্যানার্জি বলেন, ‘‘রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকলেও মধ্য কলকাতার একাধিক কলেজের ছাত্র সংসদ ছিল ছাত্র পরিষদের দখলে। নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র পরিষদের কর্মীরা কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে আসতো মিছিল করে। সেই সময় একটা ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। রাখাল দা আমাদের আগের থেকে সতর্ক করে দিতেন যাতে সেই সময় আমরা ইউনিয়ন রুমে না থাকি। অনেক বার এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, রাখাল দা সতর্ক করায় আমারা ইউনিয়ন রুমে থাকিনি। কিন্তু সেই দিন ইউনিয়ন রুমে হামলা হয়েছে। আমরা কেউ আক্রান্ত হয়নি। আবার অনেক সময় ছাত্র পরিষদের মিছিল ঢুকতে দেখলে আমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে নিজেই ইউনিয়ন রুমে তালা দিয়ে দিয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সংগঠনের কাজের জন্য রোজ সকালে ক্যাম্পাসে আসতাম। ভালো ভাবে খাওয়া হতো না। রোজ সন্ধ্যায় বাড়ি যাওয়ার সময় রাখাল দা ডেকে আমাদের যে খাবার বাঁচতো তা খাইয়ে দিতেন।’’ 
কেন বার বার এসএফআই কর্মীদের আগলে রাখতেন রাখাল দা? তাহলে কি তিনি বামপন্থী ? এই প্রসঙ্গে তরুণ ব্যানার্জি বলেন, ‘‘রাখাল দা’র এই ভূমিকা সম্পর্কে প্রয়াত মানব মুখার্জি’র নিজস্ব একটি মুল্যায়ন ছিল। আমি নিজেও এই কথা মনে করি।’’ তিনি বলেন, ‘‘রাখাল দা প্রয়াত হওয়ার পর ২০০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সব প্রাক্তনীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বুদ্বদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, মানব মুখার্জি, পবিত্র সরকার, সমরেশ মজুমদারদের মতো প্রাক্তনীরা উপস্থিত। সেখানে রাখাল দা’র স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রাখাল দা’র বিভিন্ন দিক উঠে আসে। সেখানেই মানব মুখার্জি বলেন, রাখাল দা বামপন্থী কি না জানা নেই। কিন্তু রাখালদা একজন ছাত্র দরদি। তাই তিনি ছাত্রদের সব সময় আগলে রাখতেন।’’       


প্রমোদ দা’র ক্যান্টিনের মতো তালা পড়েছে রাখাল দা’র ক্যান্টিনেও। রাখাল চন্দ্র ঘোষ মারা যাওয়ার পর তাঁর ক্যান্টিনের কর্মীরাই ক্যান্টিন চালাতো। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকেই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয় তা বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু প্রাক্তনীদের এবং ছাত্রদের চাপে তা বন্ধ করা যায়নি। কিন্তু পরবর্তী সময় ক্যান্টিনের কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কাজে নিয়ে নেওয়ার পর পুরোপুরি তালা পরে ক্যান্টিনের দরজায়।

 
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের মতো আলিপুর ক্যাম্পাসের প্রাক্তনী এবং পড়ুয়াদের কাছে বিখ্যাত নগেন দা’র ক্যান্টিন। ১৯৮৯ সাল থেকে চলছে সেই ক্যান্টিন। বর্তমানে নগেনদা না থাকলেও তাঁর স্ত্রী ক্যান্টিন চালান। তাই এখন তার নাম হয়েছে ‘মাসির ক্যান্টিন’। চাকচিক্য না থাকলেও ক্যান্টিনে রয়েছে একটা মায়া। নিজের সন্তানের মতো ছেলে মেয়েদের কাছে বসিয়ে খাওয়ান সবার প্রিয় মাসি। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা অনেক চেষ্টা করেছে এই ক্যান্টিন তুলে দিয়ে মোটা টাকার বিনিময় কোনও সংস্থার হাতে তা তুলে দিতে। কিন্তু তা তারা করে উঠতে পারেনি। 
একইভাবে এখনও যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রী প্রাক্তনীদের কাছে বিখ্যাত মিলন দা’র ক্যান্টিন। ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা শুরু করেন মিলন দে। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন সেই ব্যবসা দেখছেন তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা দে এবং সন্তানরা। আর মিলন দা মানেই ‘ঢপের চপ’। না। এই ঢপ মানে মিথ্যে না। একটা আস্ত চপ, যেটা খেলে মোটামুটি অনেকক্ষণ কিছু আর খেতে হবে না। 
এই ক্যান্টিন সাক্ষী থেকে বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছাত্র জীবনের। রাখাল দারা যেমন সবাইকে মনে রাখতেন তেমনই তাঁদেরও মনে রাখতেন বাকিরা। রাখাল চন্দ্র ঘোষ যখন অসুস্থ ছিলেন তখন তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সি’র ২০০ বছর পূর্তি মিছিলে প্রাক্তনীরা যখন হাঁটলেন। শঙ্খ ঘোষ সেই মিছিলে পা মেলালেন। সেই মিছিলে ফিটন গাড়ি করে ঘোরানো হয়েছিল প্রমোদ সাঁইকে। 
কালের নিয়মে সবই হয়তো হারিয়ে যাবে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন হারিয়ে যাবে হয়তো। তৈরি হবে নতুন ধারণা ‘কমারসিয়ালাইজেন অব ক্যান্টিন’। কিন্তু তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখতে গেলে বার বার উঠে আসবেন প্রমোদ সাঁই, মিলন দে, রাখাল চন্দ্র ঘোষরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment