ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসে আমনের পাকা ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। মাথায় হাত রাজ্যের আমন ধান চাষ করা কৃষকদের। তাদের একটাই কথা এবার আর ধান পাবো না- হয়তো খড়টুকু পাব। ক্ষতির মুখে শীতকালীন শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের রবিশস্য। ঘরে তোলার সময় ধানগাছ নুয়ে পড়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। শুক্রবার সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু। দুপুরের দিকে কোথাও কোথাও বৃষ্টি থামলেও শনিবারেও আকাশ মেঘলা রয়েছে। চলছে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি সেই সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। যার জেরে পুরুলিয়ায় ধান চাষে ক্ষতি হয়েছে বলে বলে দাবি কৃষকদের। পাশাপাশি মাঠে থাকা সবজিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি কৃষকদের। ঝালদার কৃষক মন্টু কর্মকার ও গঙ্গাধর রজক জানান‘ ‘‘বছরে একবার মাত্র চাষ করার সুযোগ পাই। শুধুমাত্র ধান চাষ করে তাদের সারা বছরের রোজগার উঠে। এই অকাল দুর্যোগে আমাদের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা তাই আমরা সমস্যায় পড়েছি। সরকারের কাছে আমরা ক্ষতিপূরণের দাবি রাখবো।’’ মন্টু কর্মকার জানিয়েছেন, ‘‘তিনি প্রায় দু বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন। সেই জমির সমস্ত ধান হাওয়ায় নুয়ে পড়েছে। মাটিতে জল জমে আছে। ধান পড়ে যাওয়া মানে সব শেষ। সমস্ত পরিশ্রম বৃথা। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।’’ জেলা কৃষি দপ্তর থেকে যতই ক্ষতি না হওয়ার গল্প শোনাক চাষীদের সাফ কথা ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেল।
দানার তান্ডবের চেয়ে জেলায় বেহাল নিকাশী ব্যাবস্থার কারণে ফসল নষ্টের মুখে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে। ভুক্তোভোগী কৃষকদের অভিযোগ তৃণমূলের শাসনে নয়নজুলি ভরাট করে দোকান বসতি গড়ে উঠেছে নিকাশী ব্যাবস্থা নষ্ট করে। পাশাপাশি গত ১৩ বছরে চাষের জমির অতিরিক্ত জল পাশ করার ক্যানেলগুলি সংস্কার না করায় মজে গিয়েছে। সেই কারণে চাষের জমিতে আরোর বড় বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। দানার তান্ডবে যেমন ফসলের ক্ষতি, তার চেয়ে জমা জল বের না হওয়ার কারণে ফসলের ব্যাপকতম ক্ষতি হওয়ার মুখে। কৃষক আজ সর্বশান্ত হওয়ার মুখে। এক এক মৌজায় চাষের জমির ধানের ফসল নষ্ট দেখে কৃষকরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একে বন্যায় বেশীর ভাগ ফসল নষ্ট হয়েছিলো ঘাটাল ডেবরা চন্দ্রকোনা দাসপুর ব্লকের ১২শো’র বেশি মৌজায়। এই ব্লক গুলির ডাঙা জমিতে যেটুকু ফসল বেঁচে ছিলো তাও দানার তান্ডবে এবং বেহাল নিকাশীর কারণে সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার মুখে। জেলা জুড়ে ধানের গাছ শুয়ে পড়েছে কাদা জলে। ফসল বাঁচাতে মাঠেই কৃষকরা। কখনো রোদ, কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে জমা জলের তলায় ডুবে থাকা ধান গাছকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করানোর মরিয়া চেষ্ঠা। কোথাও স্বপরিবারে, কোথাও ক্ষেতমজুর লাগিয়ে শেষ সম্বল টুকু রক্ষা করতে মাঠেই ভোর থেকে সন্ধ্যা হাত লাগালেন কৃষকেরা। এক মাস আগেই বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয় ধান সবজির। বাকী ডাঙ্গা জমিতে যেটুকু ফসল ছিলো তাও দানা’র দাপটে নষ্ট হওয়ার মুখে।
বৃষ্টিতে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কালনা মহকুমায়। এই মহকুমার পাঁচটি ব্লকে ব্যাপক আমন ধানের চাষ হয়। তবে মন্তেশ্বর ব্লক আমন ধান চাষে এগিয়ে। বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার সারাদিন বৃষ্টিতে আমন ধানের জমিতে জল জমে গিয়ে সদ্য ফুলানো ধান একেবারে শুয়ে পড়েছে। এই ধানগাছ উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এই ধান গাছে আর ফলন হবে না, সবই চিটে হয়ে যাবে। তাই কৃষকরা ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়া নিশ্চিত। কৃষি দপ্তরও আমন ধানের ক্ষতি হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে।
জল জমে আছে সব্জি খেত, ধান জমিতে। নুয়ে পরা ধান গোছা বেঁধে বাঁচানোর চেষ্টা কৃষকদের। সব্জি জমি থেকে জল বের করে গাছের চারা বাঁচানোর চেষ্টাও করছেন হুগলির কৃষকরা। জেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে এখনো পর্যন্ত যা হিসাব পাওয়া গেছে তাতে ১০ শতাংশ জমির ধান ক্ষতির আশঙ্কা। উদ্যান পালন দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় বারোশো হেক্টর জমির সব্জি চারা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দানা ঘূর্নিঝড়ের প্রভাবে গত দুই দিন ধরে একটানা বৃষ্টি হয়েছে। হুগলি জেলায় দুই দিনে মোট ১০৭ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত বছর জেলায় মোট বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১০৮৬ মি.মি। চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত হয়েছে ১৫৭৭ মি.মি। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত বছর বৃষ্টি হয় ৮৬০ মিমি। এবছর সেই সময়ে হয়েছে ১২৮১ মিমি। কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গেছে গড় বষ্টি পাতের প্রায় ২৫ শতাং বেশি বৃষ্টি হয়েছে। দুর্গা পুজোর আগে ভারী বৃষ্টি ও বন্যার কারণে অনেক চাষ নষ্ট হয়েছিল। নতুন করে যারা আবার চাষ করেছিলেন তাদের গাছ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পোলবা কাশ্বারা গ্রামের কৃষক রফিকুল মল্লিক দশ বিঘা ধান চাষ করেছিলেন। সেই ধান গাছ জমিতে পরে গেছে। টমেটো লাউ চাষ করেছিলেন সেই গাছও বাঁচানো যাবে কিনা চিন্তায়। ঋণ নিয়ে চাষ করেছেন দুবার, খরচ হয়েছে অনেক। সেই টাকা তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
সুগন্ধা মালতপাড়ার বাসিন্দা লসো হেমব্রম জমি ভাগে নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন। জমিতে জল জমেছে। আর দিন পনেরো পর ধান কাটার কথা ছিল তার আগেই এই বৃষ্টিতে ধান গাছ শুয়ে গেছে। গোছা বেঁধে ধান বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন বিঘা প্রতি প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধানের ফলন যেমন ভেবেছিলেন তেমন হবে না মনে করছেন। মাচায় ঢ়েরশ চাষ করেছেন অতিবৃষ্টিতে সেই গাছও বাঁচবে না।
উদ্যান পালন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কৃষকদের ২৮৫০ টি শিড মিনিকিট দেওয়া হয়েছে। যেখানে লাউ কুমরো টমেটো ও বাঁধাকপির বীজ আছে। বন্যা পরবর্তী সময়ে চাষের জন্য এগুলো বিলি করা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় দানার ফলে যে বৃষ্টি হয়েছে তার পর রোদ উঠছে ভ্যাপসা গরমে গাছের চারা মরে যেতে পারে তাই কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ওষুধ প্রয়োগ করতে।
হুগলি জেলা কৃষি উপ-অধিকর্তা মৃত্যুঞ্জয় মারদানা বলেন,‘‘খারিফ মৌসুমে যে ধান চাষ হয়েছে তার মধ্যে যমুনা নীলাঞ্জনা এই প্রজাতির ধান প্রায় মাঠে ঘুরে দেখা হয়েছে প্রায় পাঁচ থেকে দশ শতাংশ জমির ধান শুয়ে পরেছে। ফলনটা যাতে ঠিকঠাক পায় কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অ্যাসেসমেন্ট সম্পূর্ণ হলে বোঝা যাবে। জেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে, কৃষি দপ্তরের কর্মীরা মাঠে ঘুরে খতিয়ে দেখছেন।’’
Cyclone Dana Affected
দানার প্রভাবে নুয়ে পড়েছে পাকা ধান, ক্ষতির মুখে কৃষকেরা
×
Comments :0