ডেঙ্গু মোকাবিলা দূরের কথা আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য দেওয়াই বন্ধ করে দিল রাজ্য সরকার। কেন আক্রান্তের মোট তথ্য ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে না প্রশ্ন তুলল সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলগুলি। গত কয়েক মাস ধরে শুধুই নির্দেশিকা জারি হয়ে চলেছে, কাজ কোথায়? জানতে চাইছেন সাধারণ মানুষ। গত সেপ্টেম্বর মাসে নবান্নের বৈঠকে একদফা নির্দেশিকায় সমস্ত হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে ফিভার ক্লিনিক খোলার কথা বলা হয়েছিল। তাহলে এই মাঝ নভেম্বরে ফের রাজ্যের সব হাসপাতালগুলিতে নতুন করে ফিভার ক্লিনিক খুলতে বলার অর্থ কী? এই দুই মাসে কী কাজ হলো? বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পড়ে স্বভাবতই দিশাহারা রাজ্য প্রশাসন।
ডেঙ্গুর ভয়ঙ্কর বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ রয়েছে বহুল মাত্রায়, উদ্বেগ রয়েছে পৌর স্বাস্থ্য বিভাগেরও। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সেখানে ডেঙ্গুর বিপদকে লঘু করে দেখাতেই ব্যস্ত তৃণমূল পরিচালিত পৌর প্রশাসন। এই তথ্য চাপা দেওয়ার প্রবণতাই সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে বলে অভিমত চিকিৎসকদের। এদিকে রাজ্যে এখনও প্রতিদিনই শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলেছেন বলে বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের খবর। এপর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। মৃত্যু সংখ্যাও অন্ততপক্ষে ৯০-র ঘরে বলে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য। তবে রাজ্য সরকার তা স্বীকার করছে না। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কোথাও না কোথাও প্রায় রোজই মৃত্যু ঘটছে ডেঙ্গুতে, তার খবর মিলছে দেরিতে।
রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতে গেলেই মশারির ভেতরে অসংখ্য রোগীর দেখা মিলছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ছাড়াও ম্যালেরিয়ার বহু রোগী রয়েছেন সেখানে। অনেকেই আছেন ভেন্টিলেশনে। জ্বর নিয়ে দৈনিক বহু মানুষ পৌঁছাচ্ছেন হাসপাতালগুলিতে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে জ্বরের গতি প্রকৃতি নিরীক্ষণ করা বা সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না পরিকাঠামোর অভাবে। তার ওপর মশাবাহিত ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সেই কারণে বারে বারে চিকিৎসকরা সব চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে ফিভার ক্লিনিকের ওপর জোর দিয়েছিলেন অনেক আগেই। এর আগে নবান্নে বৈঠকেও তা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু কাজ যে কিছুই হয়নি তার প্রমাণ মিলেছে বুধবার নবান্নে আরও একবার সেই প্রসঙ্গ উঠে আসায়। নবান্নে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলি কি শুধু রুটিন কাজ? রাজ্যের ডেঙ্গু কবলিত বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ দেখিয়ে এই প্রশ্নই তুলছেন বিরোধীরা।
গত ৩ নভেম্বর শেষবার রাজ্য সরকার ডেঙ্গু অ্যানালিসিস রিপোর্ট প্রকাশ করে। এরপর থেকে অত্যন্ত অনিয়মিত ও দায়সারাভাবে শুধুমাত্র দৈনিক কত টেস্ট হলো আর কত আক্রান্ত হলো তার কিছু কিছু বলা হয় স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্বাস্থ্য দপ্তর যে সামান্য তথ্য দিচ্ছে তাতে কোনোভাবেই রাজ্যের ডেঙ্গু পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র কিছুতেই পরিস্ফুট হচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্রে যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, মুর্শিদাবাদ, শিলিগুড়ির পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত উদ্বেগজনক, ডেঙ্গু কমার কোনও লক্ষণ নেই। কলকাতার মেয়র বলেছেন, পৌরসভার কাজ ভালোই চলেছে, সাধারণ মানুষ সচেতন নয় তাই ডেঙ্গু বাড়ছে। বুধবার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য)ও বলেছেন এত উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু মাত্র ৩ দিন আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে কাউন্সিলরদের গাফিলতির কথা মেনেছেন মেয়র পারিষদ। মৃত্যু নিয়ে অবশ্য কোনও তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই তাঁদের মুখে।
মুখ্যমন্ত্রী ডেঙ্গু প্রসঙ্গ হালকা করে দিয়ে বলেছিলেন, ডেঙ্গু একটু একটু আছে, ঠান্ডা পড়লে কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা এমন আকার নিয়েছে যে বুধবার স্বাস্থ্য দপ্তর নতুন করে কিছু নির্দেশিকা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে, অর্থাৎ ডেঙ্গু কমার বদলে বেড়েছে। রাজ্যবাসীর বক্তব্য, এলাকা সাফাই নিয়ে কাউন্সিলরদের কাছে গেলে শুনতে হচ্ছে কর্মী কম, তাই সাফাই কাজ হতে সময় লাগবে। কিন্তু কত সময়? গত কয়েক মাস ধরেই দেখা যাচ্ছে বহু ওয়ার্ডে এলাকার পর এলাকায় কোনোই নজরদারি নেই। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে জ্বর নিয়ে গেলেই রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না সব ক্ষেত্রে। আরও অভিযোগ, রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে, রিপোর্টে সব সময়ে ডেঙ্গুর উল্লেখ থাকছে না। বেসরকারি ল্যাব থেকে অনেক টাকা দিয়ে করাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীর পরিবারের সদস্যরা। দিশাহারা সরকার যে হাত তুলে নিয়েছে তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সবার কাছে।
Comments :0