ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নাকি তার ভাসুরের নাম উচ্চারণ করেনা। ভারতীয় সমাজের একটা বৃহত্তর অংশে এমনটাই রীতি। কিন্তু কেউ তার ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে পারবে না এমন কোনো রীতি কোথাও চালু নেই। প্রশ্নটা উঠেছে দেশের সবচেয়ে ধনী শিল্পপতি গৌতম আদানিকে কেন্দ্র করে। তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ট। মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-র রিপোর্ট অনুযায়ী মোদী ঘনিষ্ট আদানি গোষ্ঠী জালিয়াতি ও কারচুপি করে কৃত্রিমভাবে তাদের কোম্পানির শেয়ার মূল্য অবিশ্বাস্যভাবে বহুগুণ বাড়িয়েছে এবং সেই অতি বর্ধিত শেয়ার মূল্যের ভিত্তিতে ব্যাঙ্ক থেকে এবং বাজার থেকে বিপুল ঋণ সংগ্রহ করেছে। তেমনি অস্বাভাবিক বেশি মূল্যে শেয়ার ছেড়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঘরে তুলেছে। এমন গুরুতর অভিযোগ এর আগেও বার কয়েক উঠেছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মোদী সরকার নীরবতা পালন করে আদানিদের পরোক্ষে সমর্থন যুগিয়ে গেছে।
শেয়ার বাজার তথা আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেবি ও কোনো অজানা কারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। হাত গুটিয়ে ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশের সেই পুরনো প্রশ্নটিই জোরালোভাবে সামনে এসেছে। রিপোর্ট প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্যে লাগাতার পতনে গোষ্ঠীর মোট শেয়ারের বাজার মূল্য অর্ধেক হয়ে যায়। তার ফলে গুরুতর আশঙ্কায় পড়ে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে লগ্নিকারিরা। ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলির উদ্বেগ বেড়ে যায়। বিপুল বিনিয়োগকারি রাষ্ট্রায়ত্ত এলআইসি’র বিপদ বাড়ে। সর্বোপরি দেশের আর্থিক স্থিতি টালমাটাল হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই অবস্থায় বিরোধীরা সোচ্চার দাবি তোলে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার জালিয়াতি নিয়ে সংসদীয় তদন্ত হোক অথবা সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হোক। আদানিদের বিরুদ্ধে শেয়ার প্রতারণার যে অভিযোগ তা খতিয়ে দেখা হোক।
বিরোধীরা এমন অভিযোগও তোলেন যে মোদী ঘনিষ্টতার কল্যাণেই আদানিরা নির্ভয়ে জালিয়াতি করেছে। এমনকি মোদীর নির্দেশেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। এলআইসি-কে বাধ্য করা হয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে আদানিদের বিপুল শেয়ার কিনে তাদের পকেট ভরাতে। একইভাবে সেবি-রিজার্ভব্যাঙ্ককেও কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। বিরোধীরা আরও দাবি করেছে প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলুন। তাঁর সঙ্গে আদানিদের সম্পর্ক দেশবাসীকে জানান। এটাও স্পষ্ট করুন তাঁর সরকার আদানিদের কীভাবে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। এমন প্রশ্নও উঠেছে মোদী জমানায় বিজেপি’র তহবিলে আদানি গোষ্ঠী কত টাকা ঢেলেছে তা স্পষ্ট করে বলা হোক।
এইসব প্রশ্নকে ঘিরে কয়েকদিন সংসদ অচল হয়েছিল বিরোধীদের প্রতিবাদে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী সংসদে মুখ খুললেও আশ্চর্যজনকভাবে আদানি প্রশ্নে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একবারের জন্যও নাম করেননি আদানির। এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট ভাষণ দিয়েছেন, বাকি সব কথা বলেছেন কিন্তু বলেননি আদানিদের জালিয়াতির কথা। ঘনিষ্ট শিল্পপতির দুর্নীতি ঢাকা দিতে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রতারণার অভয় দিতে তিনি এড়িয়ে গেছেন। আত্মরক্ষার জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন দেশের জনগণকে। ভাবখানা এমন বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের জনগণকে তাঁর সরকার কিছু সুবিধা দিয়েছে বলে জনগণ জালিয়াতি সংস্রবের জন্য তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন। আদানিদের সবরকমের বৈধ-অবৈধ সুবিধা দিয়ে রাতারাতি বিশ্বের তৃতীয় ধনপতিশ্রেষ্ঠ বানানোর জন্য জনগণ নাকি তাঁর পাশে থাকবেন।
বলেছেন ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিয়েছেন। এটা তাঁর বদান্যতা নয়। বরং ইউপিএ সরকারের তৈরি খাদ্য নিরাপত্তা আইনে এটা বাধ্য বাধকতা। তেমনি অন্যান্য প্রকল্পও তাঁর দয়ার দান নয়। জনগণের করের টাকায় জনগণের জন্য সব সরকারই প্রকল্প রূপায়ণ করে। মোদী তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি জনগণকে দান করেন না। দেশটা তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জমিদারি নয়। জনগণ ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করেন। সরকারের কাজ জনগণের স্বার্থে কাজ করা। কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা ঘনিষ্ঠ শিল্পপতির সেবা করা নয়। আবার এটাও তাঁর মনে রাখা দরকার যে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই নির্বাচনে দেশের মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষ তাঁর দলকে ভোট দিয়েছেন। বাকি ৬৮ শতাংশ তাঁর এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে অর্থাৎ বিরোধীদের ভোট দিয়েছেন। সেই বিরোধীরাই আদানি জালিয়াতির তদন্ত চাইছেন। অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ দেশবাসীর প্রত্যাশা উচ্চারিত হচ্ছে বিরোধীদের কণ্ঠে। পালিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
Comments :0