Gujrat Rega

‘ডবল ইঞ্জিন’-এও রেগার বেহাল দশা গুজরাটে

জাতীয়

গুজরাটে ডবল ইঞ্জিন কোথায়? সিঙ্গল ইঞ্জিনও কাজ করছে না। নয়তো রেগার কাজের এই দশা হয়? গুজরাটে রেগা প্রকল্পের বেহাল দশা নিয়ে এরকমই মন্তব্য গ্রামবাসীদের। রেগায় নাম নথিভুক্ত থাকলেও কাজ মেলে না। কাজ মেলে তো মজুরি মেলে না। কী লাভ ডবল ইঞ্জিন সরকারের? গ্রামবাসীদের এই প্রশ্ন তাড়া করছে বিজেপি’কে। হাতে কাজ চাই, এটাই  প্রধান ইস্যু হয়ে গিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে। কংগ্রেস, আপ, বামপন্থী সহ সব বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারে কাজের দাবি হলো প্রধান ইস্যু। মোদীর ‘তার গড়ে তোলা গুজরাটে’ কাজের হাহাকার নিয়ে কোনও কথা নেই বিজেপি’র। বছরে ২কোটি চাকরি তো দূরে থাক, বছরে কেন রেগায় ১০০ দিনের কাজ মেলে না রাজ্যে তা নিয়ে জবাব নেই শাসক বিজেপি’র। রেগার বেহাল দশা নিয়ে নীরব বিজেপি। 
প্রসঙ্গত, গুজরাটে গরিব আদিবাসী দলিতদের গ্রামে বছরের পর বছর দেখা যাচ্ছে ৫০ দিনও রেগায় কাজও মেলে না। মহামারীর সময়ও একই হাল ছিল গ্রামে। পঞ্চায়েতে রেগার কাজ চাইতে গেলে ‘কাজ নেই’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচন এসে যাওয়ায় সেই গুজরাটে রাজমহল, গোধরা সহ বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একের পর এক প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তিনি আদিবাসী এলাকায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করে গিয়েছেন। আদিবাসী সংগঠনের সাফ কথা, কাজের খোঁজে বছরভর দেখা মেলে না রাজ্য সরকারের। নির্বাচন এলেই এরকম প্রকল্প প্রতিবারই চলে। তার পুঁতে যাওয়া শিলা পড়ে থাকে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু গরিব আদিবাসী এলাকায় রেগার কাজও কেন মিলবে না? গুজরাটে বিজেপি’র ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার, তবুও রেগাতে কাজ মেলে না। গুজরাট সরকারের তথ্য জানাচ্ছে, ৩২ লক্ষ সক্রিয় রেগা কর্মীর মধ্যে ৩৫ হাজারের বা ১ শতাংশেরও পুরো ১০০ দিন কাজ মেলে না। কাজ চেয়েও না পাওয়ার তালিকায় সব চেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন দলিত আদিবাসীরাই। 
আদিবাসী এলাকায় মোদীর প্রতিশ্রুতির বহর নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। গরিব আদিবাসী ও দলিতের আয় জোগাতে হাতে কাজ নিশ্চিত করতেই ইউপিএ আমলে আনা হয়েছিল রেগা প্রকল্প। মোদীর দাবি মতো তার ‘মডেল রাজ্য’ গুজরাটেই সেই রেগা প্রকল্প লাটে উঠেছে। 
আদিবাসী সংগঠন গুজরাট সরকারের তথ্যে উল্লেখ করে জানাচ্ছে, এবছর ১৪ মার্চ পর্যন্ত রাজ্যে রেগা প্রকল্পে ৪৭.২৭ লক্ষ জব কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। কাজ না মেলায় তার মধ্যে মাত্র ১৮.৬১ লক্ষ কার্ড সক্রিয় রয়েছে। এই মুহূর্তে রাজ্যে সক্রিয় রেগা কর্মীর সংখ্যা ৩২ লক্ষ। তার মধ্যে তফসিলি সম্প্রদায়ের রেগা কর্মীর সংখ্যা ৫.৮১ শতাংশ। আদিবাসী দলিতের সংখ্যা ৩৯.৪ শতাংশ। কেন্দ্রের ২০২১ সালের ১ এপ্রিলের নোটিস অনুসারে রেগায় দৈনিক ন্যূনতম মজুরি হলো ২২৯ টাকা। কিন্তু গুজরাটে রেগায় সেই ন্যূনতম মজুরি মেলে না। সেখানে রেগায় দৈনিক মজুরি মেলে ২০৫ টাকা। রেগা আইনে রাজ্য সরকারের ১০০ দিনের কাজ নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু গুজরাটে ৫০ দিনের বেশি কাজ মেলে না রেগায়। বাকি ৫০ দিনের কাজ না দেওয়ায় কর্মপ্রার্থীদের বেকার ভাতা দেওয়া উচিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত রেগায় বেকার ভাতার নামই শোনেননি গুজরাটবাসী!
উল্লেখ করা যেতে পারে, গত দু’বছর মহামারীতে সারা দেশের মতো গুজরাটেও লকডাউনে হাট-বাজার, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ ছিল। সেসময় বহু মানুষ কাজ হারান। ফলে রেগায় কাজের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, সেই বছরে আরও কম দিন অর্থাৎ মাত্র ৪৩ দিন কাজ মিলেছে! এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সক্রিয় ১৮.৬৩ লক্ষ রেগাকর্মীর মধ্যে গত পাঁচ বছরে মাত্র ৩৫ হাজার কর্মীর ১০০ দিন কাজ মিলেছে। বাকিদের গড়ে ৫০ দিনের কম কাজ মিলেছে। 
এদিকে রেগায় গত পাঁচ বছরে ১৫.৮২ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছরে গড় বৃদ্ধি ৩.১৬ শতাংশ। বছরে এখন গড় মূল্যবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। বরং তা কমে গিয়েছে। রেগার আইন অনুসারে দেশের ন্যূনতম মজুরি যা ঘোষণা হবে রেগাতেও ন্যূনতম মজুরি তাই স্থির হবে। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি হলো ৩২৪ টাকা। তবে নিয়ম ভেঙে গুজরাটে রেগায় ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হয় ২২৮ টাকা।
এদিকে মোদীর ‘মডেল রাজ্য’ গুজরাটে শুধু রেগার কাজই মেলে না তাই নয়, শ্রমিকদের মজুরিও সময়মতো মেলে না। রেগা আইনে বলা হয়েছে, কাজ হয়ে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই মজুরি মিটিয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন জেলায় অনেকের দু’মাস থেকে তিন মাসের ওপরে মজুরি বাকি। তার মধ্যে আবার পঞ্চায়েত অফিসে আদিবাসী দলিত মানুষ কাজের সন্ধানে গেলে তাঁদের কাজ নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা কাজের জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে গেলেও তাঁদের হটিয়ে দেওয়া হয়। এখবর জানিয়েছেন রেগা ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি অধ্যাপক হেমন্তকুমার শাহ। তাঁর কথায়, এভাবে গুজরাটে রেগার কাজ থেকে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন আদিবাসী দলিত গরিব মানুষরাই। অনেকেই বলেন, আসলে পরিকল্পিতভাবেই রেগায় তাঁদের নাম নথিভুক্ত হয় না, যাতে গুজরাটে কাজের চাহিদা কম করে দেখানো যায়।
এদিকে শুধু গুজরাট নয়, সারা দেশেই দেখা যাচ্ছে নাম নথিভুক্তির পরে জব কার্ড পেলেও সকলের কাজ মেলে না। সম্প্রতি ন্যাশনাল কনসর্টিয়াম অব সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন রেগা নিয়ে তাদের সমীক্ষায় জানাচ্ছে, দেশে রেগায় যাঁদের নাম নথিভুক্ত হয়ে জব কার্ড রয়েছে ২০২০-২১ সালে মহামারীর সময়ে তাঁদের ৩৯ শতাংশের একদিনও কোনও কাজ মেলেনি। তাঁদের মাত্র ৩৬ শতাংশের ৫০ দিনের কম কাজ মিলেছে। রেগা প্রকল্প নিয়ে গবেষণায় যুক্ত আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র নারায়ণ বলেন, মহামারীর সময়ে কাজ হারানো মানুষদের রেগার কাজ পাওয়া খুব জরুরি ছিল। অন্তত ১০টি পরিবারের মধ্যে ৮টি পরিবারের ১০০ দিন কাজ নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই কাজের জোগান দেওয়া যায়নি। তিনি বলেন, সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৬৯ শতাংশ পরিবার জানাচ্ছে জব কার্ড থাকলেও কাজ চাইতে গেলেও বলা হয়েছে কাজ নেই। তিনি আরও জানান, রেগায় মানুষের হাতে নগদ অর্থের জোগান বাড়াতে মজুরিতে যে অর্থের সংস্থান করা দরকার ছিল তা করা হয়নি। ২০২০-২১ সালে মহামারীর সময়ে মজুরিতে একটি ব্লকে বরাদ্দ করা হয় মাত্র ১৫২ কোটি টাকা। যেখানে বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল ৪৭৪ কোটি টাকা। মজুরি খাতে প্রয়োজনের এক-চতুর্থাংশ বরাদ্দ করে দায় সারা হয়েছে।
এদিকে ঠিক নির্বাচনের মুখে রেগায় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় গ্রাম উন্নয়ন দপ্তর অর্থ মন্ত্রকের কাছে রেগার জন্য অতিরিক্ত ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন জানিয়েছে। কেন্দ্রের অর্থ দপ্তরকে সূত্র করে এখবর জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই। জানানো হয়েছে, ২০২২-২৩ সালে বাজেটে রেগায় বরাদ্দ হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই রাজ্যগুলিকে বণ্টন করা হয়েছে। এতে ১৮১ কোটি শ্রমদিবস তৈরি হয়েছে। এবার বছর শেষে বরাদ্দ বেড়ে ৯৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর রেগায় বরাদ্দ কমেছে। মহামারীতেও বরাদ্দ বাড়েনি কমেছে। ২০২০- ২১ সালে রেগায় বরাদ্দ ছিল ১.১১ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে বরাদ্দ ছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে বরাদ্দ কমে হয়েছিল ৭৩ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনের দায় সারতে শেষ মুহূর্তে ২৫ হাজার কোটি বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দেখা গেল মোট বরাদ্দ বিশেষ বাড়ল না।
 

Comments :0

Login to leave a comment