Anubrata Lottery Awards

লটারির ভুয়ো ‘বিজেতা’ হয়েই
অনুব্রত, সুকন্যার ১ কোটি ৬১ লক্ষ

রাজ্য

Anubrata Lottery Awards

গোরু পাচারের তদন্তের ভরকেন্দ্রে খুব দ্রুত চলে এসেছে এবার লটারি কেলেঙ্কারি। মানি লন্ডারিংয়ের কৌশল হিসাবেই ব্যবহার করা হয়েছে লটারির বাম্পার পুরস্কার। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকদের দাবি,  শুধু এক কোটি টাকা জেতা নয়, গত তিনবছরে আরও তিনবার অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর কন্যার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে রহস্যজনকভাবে লটারির বিজেতার পুরস্কার। সেই টাকার পরিমাণ ৬১ লক্ষ টাকা! গত তিন বছরে শুধু অনুব্রত মণ্ডলের পরিবারেই লটারির পুরস্কার হিসাবে ১ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল!
গোরু পাচারের টাকা সাদা করতে যেমন চালকল কেনা হয়েছে, কলকাতা ও বীরভূমে বিপুল পরিমাণ জমি কেনা হয়েছিল, একাধিক বেসরকারি বিএড, ডিএলএড কলেজে বিনিয়োগ করা হয়েছিল তেমন পাচারের টাকাই সাদা করার কৌশলেই এই লটারি কেলেঙ্কারি! রীতিমত চক্র গড়ে রাজ্যের একাধিক জেলায় চলছে এই কারবার। বিশেষত ২০১৮-১৯ সাল থেকেই রমরমা বাড়ে এই কারবারের। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই সময়টি গোরু, কয়লা ও বালি পাচারেরও রমরমা ছিল। তখন এনামুল হক থেকে অনুপ মাঝি ওরফে লালাদের দাপট চলছিল। 
সেই সময়তেই শাসক তৃণমূলের একাধিক দাপুটে নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন জেলায় লটারির পুরস্কার জেতা শুরু করেছে। ডিয়ার লটারিতে টিকিট না কেটেও অনুব্রত মণ্ডল ১কোটি টাকা ‘জিতেছিল’। শুধু তাই নয় বীরভূমের নলহাটির বিধায়ক রাজেন্দ্র প্রসাদ সিংহের ভ্রাতৃবধূ নেরু সিংহ জিতেছিলেন ১ কোটি টাকা। তাঁর স্বামী তৃণমূলের নলহাটির শহরের সভাপতি। আবার ডিয়ার লটারিতে এক কোটি টাকা পুরস্কার জিতেছেন জোড়াসাঁকোর তৃণমূল বিধায়ক বিবেক গুপ্তের স্ত্রী রুচিকা। মূলত শাসক ঘনিষ্ঠ, নেতাদের পরিবারের লোকজনই জিতছে একের পর এক বাম্পার পুরস্কার! এবার সেই রহস্য খুঁজতেই গোরু পাচারের কাণ্ডের তদন্তের অংশ হিসাবে লটারি কেলেঙ্কারি খতিয়ে দেখা শুরু করেছে সিবিআই।
ইতিমধ্যে গত সপ্তাহেই আসানসোল জেলে গিয়ে অনুব্রতকে লটারি প্রসঙ্গেই জেরা করেছিলেন সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিকরা। তদন্তে নেমে দেখা যায় শুধু মাত্র অনুব্রত মণ্ডল চলতি বছরের প্রথমে ডিয়ার লটারিতে ১ কোটি টাকা জিতেছিলেন তা নয় তার আগেও মোট তিনবার তাঁর ও মেয়ে লটারিতে বাম্পার পুরস্কার জিতেছিলেন! সিবিআই সূত্রেই জানা গেছে, ২০১৯ সালে অনুব্রত মণ্ডলের একটি অ্যাকাউন্টে লটারির পুরস্কার মূল্য হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। তার আগে সুকন্যা মণ্ডলের অ্যাকাউন্টে দু’দফায় লটারির টাকা ঢুকেছিল। প্রথমবার সুকন্যা মণ্ডলের একটি অ্যাকাউন্টে লটারির টিকিট কিনে বিজেতা হিসাবে ২৫ লক্ষ ও পরের বার ২৬ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল। অর্থাৎ দু’দফায় মেয়ের অ্যাকাউন্টেই ঢুকেছিল ডিয়ার লটারিটর ৫১ লক্ষ টাকা!আর অনুব্রত মণ্ডলের নিজে ‘জিতেছিল’ একবার ১ কোটি আরেকবার ১০ লক্ষ। অর্থাৎ শুধু অনুব্রত মণ্ডলের পরিবারে ১ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা বেমালুম ঢুকে গিয়েছিল!
সিবিআই’র একটি সূত্রের দাবি গোরু পাচারের টাকা এভাবে ঘুরপথে অনুব্রত-সুকন্যার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে। কালো টাকা সাদা করার কৌশলেই তা করা হয়েছে
আর এখানেই সেই গোলকধাঁধা। কালো টাকা সাদা করার কৌশল হিসাবে গত তিন চার বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গে চলছে লটারির এই কারবার। সেই কৌশলটা কী? কেউ যদি লটারিতে বাম্পার পুরস্কার হিসাবে  ১ কোটি টাকা জেতে সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর চলে যায় ঐ নির্দিষ্ট একটি চক্রের কাছে। এরপর সেই ব্যক্তির কাছে পৌঁছায় তাঁরা। ১ কোটি টাকা জিতলে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়কর দেওয়ার পরে প্রায় সাড়ে ৭২ লাখ টাকা হাতে পান বিজেতারা। আর এখান থেকেই শুরু হয় সেই কারবার। ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে ১ কোটি টাকা দিয়েই বা কখনও ৮০-৯০ লক্ষ টাকা দিয়ে টিকিটটি কিনে নেওয়া হয়। তাতে এই বিজেতার আপত্তির কোনও জায়গা নেই। টিকিট দিয়ে দিলে তিনি ঐ ১ কোটি বা ৮০-৯০ লক্ষ টাকা পাচ্ছেন। আয়কর কাটার পরে যে টাকা পেতেন তার থেকে বেশি। ফলে খুব সহজেই ঐ চক্রটি বিজেতার কাছ থেকে টিকিট কিনে নেয়। আসলে বিপুল পরিমান নগদ টাকা বা কালো টাকা দিয়ে টিকিট কিনে নেওয়ার পরে লটারির সংস্থার কাছ থেকে টিকিট বাবদ ও আয়কর কাটিয়ে যে টাকাটা পায় ঐ চক্র সেটি সম্পূর্ণ সাদা টাকা। ব্যাঙ্কে লেনদেন হয়। ফলে ১ কোটি বা ৮০ লক্ষ টাকার মতো কালো টাকা মুহুর্তের ব্যাঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে সাদা হয়ে যায়। এরপরে রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়েই ঐ বিজেতাকে তাঁর টাকা আবার ঐ চক্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনও কখনও নিজের সংস্থা বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে বাধ্য করে। ফলে সেই টাকা সাদা হয়ে যায়।
একেবারে হিসাব কষেই চলছে এই অর্থনীতি! কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি একদম এই মডেল অনুসরণ করেই লটারির ভুয়ো ‘বিজেতা’ বনে গিয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর কন্যা সুকন্যা মণ্ডল। 
চলতি বছরের গোড়ার দিকে ‘ডিয়ার’ নামে এক লটারি সংস্থার ওয়েবসাইটে অনুব্রতর ১ কোটি টাকার লটারির পাওয়ার বিজ্ঞাপন ফলাও করে বেরিয়েছিল ছবি সহ। শোরগোল পড়ে গিয়েছিল তা নিয়ে। অনুব্রতকে নানা সময়ে লটারি প্রাপ্তি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে অনুব্রত স্বীকারও করেননি আবার সরাসরি অস্বীকারও করেন নি। বরং হেঁয়ালি করেই এড়িয়েছিলেন প্রসঙ্গ। তার কারণই হচ্ছে এই ‘মডেল’। কেননা অনুব্রত মণ্ডল নিজেও জানেন তিনি আদৌ ডিয়ার লটারির বিজেতা ছিলেন না। কালো টাকা সাদা করতেই বিজেতার কাছ থেকে টিকিট কেনা হয়েছিল। শুক্রবারই সিবিআই হানা দিয়েছিল বোলপুরের এক লটারি এজেন্সিতে। বোলপুর বাইপাসের ধারে থাকা লটারি এজেন্সির মালিক শেখ আইনুল হাজিরা দেন সিবিআই’র কাছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বলেন, ‘আমি টিকিটটি বিক্রি করেছিলাম লাকি লটারি নামে এক সাব এজেন্টকে। সে কাকে বিক্রি করেছিল, কে-ই বা লটারির টাকা ভাঙিয়েছিল তা বলতে পারব না।’’ ডাক পড়ে সেই সাব এজেন্টেরও। সেও জানায়, ‘‘অনুব্রত টিকিট কাটেননি। লটারি প্রাপ্তির টাকা আমার কাছে ভাঙাতেও আসেনি কেউ।’’ তাহলে তৃতীয় কোনও ব্যক্তি কি জড়িয়ে আছে লটারি যোগে ? একেবারে সেই জালিয়াতির মডেল।

Comments :0

Login to leave a comment