Master Da : Kalpana Dutta

মাস্টার দা

বিশেষ বিভাগ

কল্পনা দত্ত

ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল ১৯৩৩-এর ১৪ই আগষ্ট দু'জনেরই। মাস্টারদা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন: "আমরা হাইকোর্ট করব, প্রিভি কাউন্সিল করব, তা ছাড়া ফাঁসির আগে তোর সঙ্গে দেখা করবই।শাস্তির পরেই আমাকে চাটগাঁয়ের বাইরে নিয়ে যায়। দেখা আর হয়নি। ১৯৩৪-এর ১২ই জানুয়ারী মাস্টারদার ফাঁসি হয়। ফাঁসির সময়ও জানতে পারিনি। বহুদিন পরে রাজশাহী জেলে ব'সে চাটগাঁয়ের ছেলেদের মুখে শুনিসাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ক'রে রাত বারোটায় দিয়েছে ফাঁসি। মৃতদেহ আত্মীয় স্বজনকেও দেওয়া হয়নি। মাস্টারদা আমাদের জন্য বাণী রেখে গেছেন : আমার অসমাপ্ত কাজের ভার তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম, এগিয়ে যাও, বন্ধুগণ, এগিয়ে যাও।"

    

kalpana dutta about master da

১৯২৯ সালে বিপ্লববাদী দলের সংস্পর্শে এসেছি। মাস্টারদার নাম তখনও জানি না। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কিছু আগে পূর্ণেন্দুদা (তিনি আমার বিপ্লববাদী দলে আসতে সাহায্য করেছিলেন) আমায় বলেছিলেন; “এবার চাটগাঁয় যখন যাবে আমাদের নেতা সূর্য সেনের সঙ্গে তোমায় পরিচয় করিয়ে দেব।"

দেখা আর হল না। চাটগাঁয় যাওয়ার আগেই ১৯৩০-এর এপ্রিল মাসে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়ে যায়। খবরের কাগজে উঠেছে সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবী যুবকদলের কাণ্ড।

দিন ১৫।২০ পরে চট্টগ্রামে আসি গরমের ছুটিতে। সান্ধ্য-আইন, পুলিসের মহড়া, খানাতল্লাসের হিড়িক, সাহেব-মেমদের সন্ধ্যার আগে শহর ছেড়ে গিয়ে স্টিমারে রাত্রি যাপনসব দেখে মনে হত কর্তৃপক্ষ ভীষণ আতঙ্কিত।

মাস্টারদা সম্বন্ধে শোনা যেত নানা কথা। কিভাবে তিনি পালিয়ে গেলেন বুড়ো মালি সেজে পুলিশের বেড়াজালের মাঝখান থেকে, কিভাবে সন্ন্যাসী সেজে আমাদেরই গ্রামের কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন, আবার কোনদিন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে গেলেন, কেউ টেরও পেল না, ধরতেও পারল না, এমনি আরো অসম্ভব কত গল্প। অশিক্ষিত জনসাধারণ বলত সূর্য সেন 'লুকি' (মন্ত্র) জানে, ধরা পড়বে না কোনদিন, ধরতে আসলেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। মাস্টারদা তাদের কাছে অসাধারণ পুরুষ। যে-পুরুষ সরকারকে কাঁপায় সে অসাধারণ নয়তো কি?

শিক্ষিত জনসাধারণ বলেসূর্য সেন একজন নেতা বটে। পলাশীর যুদ্ধের পর আর এমন ঘটনা ঘটেনি, সূর্য সেনের সঙ্গে পুরোনো পরিচয়ের কোনদিনের ঘটনা মনে ক'রে চুপি চুপি বলে কোনদিন কি কথা হয়েছিল, কি বলেছিলেন ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ আপনাকে জাহির করবার জন্য নিজের সঙ্গে সূর্য সেনকে জড়িয়ে মিথ্যা গল্পও বলত। সূর্য সেনের সঙ্গে পরিচয় থাকা সাধারণ ব্যাপার নয়।

পুলিশ অত্যাচার করেছে জনসাধারণের উপর নানারকমভাবে; তবু কেউ কোনদিন সূর্য সেন বা তাঁর দলের ছেলেরা ধরা পড়ুক এ-কামনা করেনি। পলাতকদের মাথার উপর হাজার হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণায় মানুষ টিটকারি দিয়ে হেসেছে, বলেছে, সূর্য সেনকে টাকা নিয়ে ধরা যায় না। যার উপর অকথ্য অত্যাচার চলেছে সে কোনদিন অভিশাপ দেয়নি সূর্য সেনকে। পুলিসের নাজেহাল হওয়ায় বরং সবাই কৌতুকই অনুভব করেছে। পটিয়া গ্রামেরই একটি ঘটনা; পলাতকদের ধরবার জন্য বাইরে থেকেও সৈন্য এসেছে, পটিয়াতে বসেছে তার একটি ক্যাম্প; তারা শুনেছে সেখানে সূর্য সেন আছে। রাতের আঁধারে ২০০/ ৩০০ সৈন্য সূর্য সেনের বাড়ী ঘেরাও করে; সকালবেলা গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হ'— 'তুমি কে'? –সূর্য সেন, 'কোন সূর্য সেন?'- মাস্টার সূর্য সেন। আর যায় কোথা। সূর্য সেন, তাতে আবার মাস্টার সূর্য সেন একেবারে হাতে হাতে ধরা পড়ে গেছে। প্রতিবাদ তো লোকটি করবেই, পলাতকেরা ওরকমই করে থাকে। এই বলে তাঁকে আটকে রাখল। শহর থেকে আই,বি গেল, সূৰ্য সেনের ছবি গেল, শনাক্ত করার লোক গেল। প্রমাণিত হল, এ সূর্য সেন স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সূর্য সেন, পলাতক সূৰ্য সেন নন। দেশবাসীর মনে পুলিশের নির্বুদ্ধিতা আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। টিটকারি দিয়ে তারা বলে এই বুদ্ধি নিয়ে সূৰ্য সেনকে এসেছ।'

১৯৩১ সালের জুন মাস। মাস্টারদা খবর পাঠালেনতাঁর সঙ্গে দেখা হবে। ঝুপঝুপ বৃষ্টি আর অন্ধকার রাত। শহর থেকে দূরে এক গ্রাম। পুজোমণ্ডপে মশারির নীচে বসে অপেক্ষা করছি, কিছুক্ষণ পরে যিনি এলেন তিনি কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর এলেন আর একজন। প্রদীপের মিটিমিটি আলোতে কিছু দেখা যায় না। ফিসফিস করে দু'জনেই কথা বলছিলেন। তাই বুঝে উঠতে পারিনি কে মাস্টারদা। পরিচয় পেলাম। ছোটোখাটো বেঁটে মানুষ, স্বল্পভাষী, দেখে কেউ মনে করতে পারে না এই সূর্য সেন চাটগাঁ শহর এমনভাবে কাঁপিয়েছে। চেহারায় অসাধারণত্ব কিছুই নেই। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছেআমি সেবার আই,এস,সি দিয়েছি। 'ভালো দেইনি' বলাতে বললেন, 'কাজ কি বেশি পড়েছিল'। জিজ্ঞাসা করার ধরনে মনে হ'ল তিনি পরীক্ষায় খারাপ করা পছন্দ করেননি।

রাত দুটো বেজে গেছে। আরো কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাস্টারদা ভবিষ্যতে আবার দেখা করবেন ব'লে চলে যেতে বললেন।

সমস্ত অনুভূতি মিলে যে-ভাবটা হয় মাস্টারদাকে দেখে হয়েছিল তাই। শ্রদ্ধা, বিস্ময়, ভয়, আনন্দ সব কিছু একসাথে। মনে হত তাঁর কথায় সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে চলে আসতে পারি। আগে ভগবানকে ডাকতাম শক্তি পাওয়ার জন্য। ভগবানকে ডাকা ছেড়ে দিলাম, বললাম মাস্টারদাই আমার ভগবান। যাকে দেখেছি তাকেই ব'লতে ইচ্ছা করত। 'আমি মাস্টারদাকে দেখেছি'। কিন্তু বলা বারণ। আমার সহকর্মী প্রীতিকে ডেকে বলতাম। জান প্রীতি, আমার মনে হয়, আমাদের মাস্টারদা ডাক্তারদার চেয়ে বড়। প্রীতি তখনও মাস্টারদাকে দেখেনি, সায় দিয়ে ব'লত আমারও মনে হয়।' 'ডাক্তারদা' শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' উপন্যাসের নায়ক, একজন স্বদেশী নেতা।

এরপরে মাস্টারদার সঙ্গে আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ফিরেছি। মাস্টারদা সম্বন্ধে সমস্ত শোনা কথা আরো সত্য ব'লে মনে করে নিয়েছি। মাস্টারদাকেও কথায় কথায় একদিন তা বলেছিলাম। মাস্টারদা উত্তর দিয়েছিলেন "সব ঘটনা সত্য নয়; বহু অতিরঞ্জিত: কিন্তু দেশের লোক আমাদের ভালোবাসে। ভালোবাসে ব'লেই চায় না আমরা পুলিসের হাতে পড়ি। তাই তারা আমাদের উপর শক্তির আরোপ ক'রে তাদের মনের ইচ্ছাটাই প্রকাশ করে মাত্র।" আমার মনে হ', দেশের লোকের ওপর কি গভীর বিশ্বাস আর ভালোবাসা মাস্টারদার।

১৯৩২ সালে, সেপ্টেম্বরে আমি ধরা পড়ি পাহাড়তলীতে। জেল থেকে ফিরে আসি দু' মাস পরে জামিনে। মাস্টারদার নির্দেশ এল পলাতক হওয়ার। দলের নীতিতে নূতন জিনিস। ১৯১৮ সালে মাস্টারদার বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা হয়। তাঁর বিয়ের বাসরে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পর্যন্ত তিনি কোন সম্পর্ক রাখেননি। ১৯২৮ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেই মাস্টারদা পলাতক হওয়ার নির্দেশ দিলেন। দলের নীতি ছিল মেয়েদের সংস্পর্শ থেকে দুরে থাকা। অনেক মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি নিজেই একদিন আমাকে বলছিলেন : কিছুতেই স্থির করতে পারছিলাম না, মেয়েদের অজ্ঞাতবাসে রাখা উচিত হবে কি না? তোদের সাহস, তোদের কর্মনিষ্ঠা আমায় পথ দেখিয়ে দিল।" কোন কিছুর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে বুঝতে পারলে তিনি তা করতে কুণ্ঠিত হ'তেন না।

পলাতক জীবনে মাস্টারদার কাছ থেকে শুনতাম সকলের জীবনীঅনন্তদা, গণেশদা, এঁদের সকলের কথা। তাঁর বলার ভেতর দিয়ে, তাঁর অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠত জীবন্ত মানুষগুলো আর তাঁদের প্রতি মাস্টারদার অসীম স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মাস্টারদার নিজের কথা জিজ্ঞাসা করলে ব'লতেন: 'ওরাই আমাকে বড় করেছে।' মাস্টারদাকে দেখতে পেতাম তাদের ভেতর দিয়ে। দেশবাসী ব'লত 'এক সূর্য সেন থাকলে হাজার হাজার অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ বেরোবে।

মাস্টারদা আরো বলতেন কিভাবে আয়ারল্যান্ডের অনুকরণে আমরা স্বাধীনতা আনব। মাস্টারদার সঙ্গেই ডান ব্রিনের এর 'মাই ফাইট ফর আইরিশ ফ্রিডম' আমরা বহুবার পড়েছি। ডান ব্রিন ছিলেন মাস্টারদার আদর্শ। আয়ারল্যান্ডের অনুকরণে চাটগাঁয়ের দলটিরও নাম ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা। মাস্টারদা ছিলেন তার প্রেসিডেন্ট।

মাস্টারদা ব'লে যেতেন : আমাদের আদর্শ স্বাধীনতা: ফাঁসিতে যাওয়া বা নিছক আত্মদানই আমাদের আদর্শ নয়; কিন্তু মুষ্টিমেয় আমরা, আমাদের কয়েকজনের প্রচেষ্টাতেই স্বাধীনতা আসতে পারে না, স্বাধীনতা আসবে না; কিন্তু প্রতিটি প্রচেষ্টা ও তার সাফল্য জনসাধারণকে নিয়ে আসবে আমাদের মধ্যে বেশি ক'রে, আমাদের সাফল্য আনবে জনসাধারণের ভিতর আত্মবিশ্বাস; আমাদের আত্মদানের মূল্য এইখানে।

রাজনৈতিক ডাকাতিতে মাস্টারদার আস্থা ছিল না একটুও। তিনি বলতেন: দু'চারটি ডাকাতিতে স্বাধীনতা লাভ হয় না; তাতে আসল উদ্দেশ্যও পণ্ড হয়ে যায়। টাকা কি ক'রে আসে তারই একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে মাস্টারদা বলছিলেন, টাকার জন্য তাঁদের কোনদিন ভাবতে হয়নি। অস্ত্রাগার লুন্ঠনের আগে হিসাব করে দেখা গেল, এ-রকম একটা পরিকল্পনা কাজে পরিণত করতে গেলে অন্তত পক্ষে ১৫,০০০ টাকা দরকার। চুরি ডাকাতি করা হবে না। হুকুম হ'ল- যে ছেলে সবচেয়ে বেশি টাকা দেবে, সেই ছেলেরই প্রত্যক্ষ কাজে যাওয়ার দাবি সর্বাগ্রে গ্রাহ্য করা হবে। তখনকার দিনে প্রত্যক্ষ কাজে যাওয়া এবং দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার জন্য একটা কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরা কেউবা দিল দু'তিন হাজার, কেউবা দিল শ'তিনেক, কেউবা মা বোনের গয়নাগাটি। কিছুদিন পরে একটি ছেলে মাস্টারদার কাছে এসে খুব কাঁদতে লাগল। কেউ বুঝতে পারে না কি হয়েছে। অনেকক্ষণ পরে সে বলল: আমি জানি আপনারা আমাকে কাজে নেবেন না; আমি ক'দিন টাকা জোগাড়ের খুবই চেষ্টা করেছি, আমার মায়ের কাছে একটি পয়সাও নেই; কাল রাতে মায়ের বাক্স ভেঙেছি, পেয়েছি এই ভাঙা রূপার বালাখানা, এতে দু'-চার টাকাও পাওয়া যাবে না।এই ব'লে বালাটি বের করে সে কাঁদতে লাগল। মাস্টারদা তাকে সান্ত্বনা দিলেন, বললেন কাজে যাওয়ার দাবি ওরই সব চেয়ে আগে থাকবে। এ গল্পটি বলতে মাস্টারদারও চোখ ছলছল করে উঠছিল। অদ্ভুত ভালোবাসতেন মাস্টারদা তাঁর প্রত্যেকটি ছেলেকে। তাদের খাওয়া-পরা ইত্যাদি প্রত্যেকটি ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন তিনি। এমন কি তাদের বাড়ি-ঘরের অবস্থা জেনে নিয়ে সেখানেও যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। পলাতক জীবনে আমাদের বহু অসুবিধা ছিল; তবু মাস্টারদা কাউকে কোনদিন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কষ্ট পেতে দেননি। তিনি বলতেন 'কৃপণতায় টাকা বাঁচানো যেতে পারে, কিন্তু আমাকে বাঁচাতে হবে আমার ছেলেদের। শুধু তাই নয়, পলাতক জীবনের একঘেঁয়ে দিনগুলো সুন্দর ক'রে কাটাবার জন্য তিনি ছেলেদের বাজনা ইত্যাদি চর্চা করবার সুবিধা করে দিতেন। তিনি নিজেও যোগ দিতেন এই সবের ভেতর। বাইরে থাকতে যে-মানুষটিকে মনে হ'ত অত্যন্ত কঠোর, অত্যন্ত গভীর, কাছে এসে দেখলাম অতি সহজে তাঁর সঙ্গে মেশা যায়। সমস্ত রকম হাসি আনন্দেও তিনি যোগ দিতেন, বলতেনমনকে প্রফুল্ল রাখতে পারা যে সব চেয়ে বড় কথা। তাঁকে গান শোনানো আমার হয়ে পড়েছিল দৈনন্দিন কাজ।

মাস্টারদার মনও ছিল অত্যন্ত নরম। আমাদের যারা মারা গেছে তাদের কথা বলতে গিয়ে মাস্টারদা অত্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়তেন। ফুটদার (তারকেশ্বর দস্তিদার) মুখে শুনেছিলামকোন ছেলেকে কাজে পাঠাবার পর অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়তেন তিনি। ফুটুদা ছিলেন মাস্টারদার বিশেষ বন্ধু, তাঁর পলাতক জীবনের সঙ্গী; কিন্তু তাই বলে কর্তব্যের সময়ে তাঁর অস্থিরতা তাঁকে অভিভূত করে ফেলত না।

১৯৩২ সালের জুন মাসের একটি ঘটনা, ধলঘাট গ্রামের একটি আশ্রয়ে তিনি। সঙ্গে আছেন নির্মল সেন আর দেখা করতে গিয়েছে প্রীতি। পুলিস খবর পেয়ে বাড়ি ঘেরাও ক'রে ফেলেছে। উভয় পক্ষের কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর নিহত হ'ল ক্যাপ্টেন ক্যামেরন, আর, নির্মলদা হলেন আহত। প্রীতিকে পুলিশ জানে না। সে পলাতকও নয়, দেখা করতে এসেছে মাত্র। কিন্তু প্রীতি আহত নির্মলদাকে ফেলে যাবে না, মৃত্যুর সময় থাকবে। আবেগকে প্রশ্রয় মাস্টারদা দিতে পারেন না। মাষ্টারদা অবিচল। অযথা মৃত্যুকে আলিঙ্গন ক'রে বৈপ্লবিক কোন উদ্দেশ্য সফল হবে তিনি মনে করেননি। মৃত্যুপথযাত্রী পলাতক জীবনের সঙ্গী নির্মল সেনকে ফেলে যেতে তাঁর মন বার বার চঞ্চল হয়ে উঠছিল। তবু তিনি প্রীতিকে নিয়ে চলে এলেন, তাঁর মাথার উপর যে আরো বড় দায়িত্ব রয়েছে।

শুধু তাই নয়, বিপদেও ছিলেন তিনি ধীর স্থির। আমার পলাতক জীবনের প্রথম দিকে। শীতের রাত, অনভ্যস্ত জীবনশীতে আমার ঘুম হয় না। ক্লান্তিতে মাস্টারদারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ ঘন ঘন দরজায় ধাক্কা ও আশ্রয়দাত্রী বুড়ির কান্না শুনে উঠে দেখি, উঠোন সৈন্যে ভরে গেছে। মাস্টারদাকে ডেকে দিয়ে টর্চ জ্বালাবার চেষ্টা করলে মাস্টারদা বারণ করলেন এবং ফুটুদাকে তিনি ডেকে দিয়ে প্রস্তুত হ'তে ব'লে নীচে চলে গেলেন। গুর্খারা শেষ পর্যন্ত আমাদের খোঁজ পায়নি, কিন্তু বিপদকে এমন সহজভাবে নিতে পারা আমি আর দেখিনি।

তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। তাঁরই কাছে শোনা গল্প, ১৯২৪ সাল হবে, দক্ষিণেশ্বরে বোমার কারখানা আবিষ্কার হয় যে রাতে সে-রাতে কলকাতায় শোভাবাজারের একটি তেতলা বাড়িও পুলিস ঘেরাও করে ফেলে। মাস্টারদারা দক্ষিণেশ্বর থেকে এসে এখানে থাকতেন। অত্যন্ত সজাগও ছিলেন মাস্টারদা। পুলিসের পায়ের শব্দে হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন- পুলিস ঘরে যখন অন্যদের গ্রেফতার করতে ব্যস্ত, তিনি তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে গিয়ে দোতলায় নেমে এলেন এবং লাফ দিয়ে অন্য একটি বাড়ীর উঠোনে গিয়ে পড়লেন। পুলিস প্রথম টের পায়নি। পরে টের যখন পেল, মাস্টারদা তখন নাগালের বাইরে।

এমন আরো অনেক ঘটনা আছে, মাস্টারদাকে দেখে কেউ চিনতে পারে না। আশ্রয়দাতারা সূর্য সেনকে চিনতে পারেনি কোনদিন। লোকের কল্পনার সঙ্গে আসল সূৰ্য সেন মেলে না। নির্মলদার বিরাট চেহারা দেখে তাঁকেই 'মাস্টারদা' 'লে অন্যে ভুল করত। কিন্তু তবু তিনি যেখানে গিয়েছেন সেখানেই সকলের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। আশ্রয়দাতারা তাঁর কাছে সংসারের সমস্ত দুঃখকষ্ট নিয়ে আলোচনা করতেন। গরিবেরা তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন, মধ্যবিত্তের ঘরেও তিনি পেয়েছেন আশ্রয়। শুধু টাকার লোভে জনসাধারণ সূর্য সেনকে আশ্রয় দেয়নি। সূৰ্য সেনকে ধরিয়ে দিতে পারলে তো সরকারের থেকে ১০,০০০ টাকা আসে। দেশবাসী সকলের কাছে মাস্টারদা হয়ে গেলেন অবতার বিশেষ। তাই তাঁর দলের ছেলেরাও এত সৈন্য মোতায়েন সত্ত্বেও আশ্রয় পেয়েছে।

মাস্টারদা সব সময়ই দেখতেন, আমাদের আশ্রয়দাতার কোন অসুবিধা বা কোন অস্বাচ্ছন্দ্য আমাদের জন্য যাতে না হয়। তিনি বলতেন: ব্যক্তিগত অভিরুচির জন্য গৃহস্থকে অসুবিধায় ফেলার তোমাদের কোন অধিকার নেই, বিপ্লববাদী হয়ে নিজেকে বশে আনতে না পারলে সে নামের যোগ্যতা তোমাদের থাকবে কি করে?” ১৯৩২ সালের শেষের দিক থেকে পুলিসের তোড়জোড় অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে। দু'বছর এত চেষ্টা করেও সূর্য সেনকে ধরতে তারা পারেনি। তাই সরকারের ধারণা হয়েছিল, সূর্য সেন চট্টগ্রামের বাইরে চলে গেছে। তাই পুলিসের সতর্কতা কিছু কমে গিয়েছিল; কিন্তু পাহাড়তলী আক্রমণ ও আমাদের পলাতক হওয়ার পর কর্তৃপক্ষের বদ্ধমূল ধারণা হয়সূর্য সেন চট্টগ্রামে আছেন। বাইরের থেকে আরো সৈন্য আমদানী হ'ল। প্ৰতি গ্রামে ক্যাম্প বসিয়ে মাস্টারদাকে ছেঁকে বের করবার আয়োজন হ'ল। মাস্টারদাকে সকলে অনুরোধ জানাল চট্টগ্রামের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য। তিনি ধরা পড়লে চট্টগ্রামের সংগঠনের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। তিনি বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন সংগঠন আবার গড়ে উঠবেই। মাস্টারদা বললেন : 'পলাতক হওয়ার পেছনে উদ্দেশ্যএখানে সংগঠন গ'ড়ে তোলা, আবার ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করা। কাজ ছেড়ে দিয়ে চুপ ক'রে ব'সে বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা আছে বলে মনে করি না। তাই চাটগাঁ ছেড়ে কোথাও আমার যাওয়া হবে না।

১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। মাস্টারদার সঙ্গে প্রস্তুত হয়েছি কথা মতো এক জায়গায় যাওয়ার জন্য। সামনে ছিলাম, কয়েক পা এগোতেই চলল রাইফেলের গুলি। প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কি। পরে বুঝলাম, আমরা পুলিসের বেড়াজালের ভেতর পড়ে গেছি। পেছন দিকে হাঁটলাম। দেখলাম আমার চোখের সামনেইসামনের ছেলেটি হাতে গুলি খেয়ে পড়ে গেল, আরো কিছুদুর গিয়ে ঝোপের অন্ধকারে মাস্টারদার নাগাল পেলাম। তিনি দেখেই বললেন: 'পথ-ঘাট তুই চিনবি না, তাই অপেক্ষা করছি"। দু'এক পা এগোতেই ছিটকে ডোবায় প'ড়ে গেলাম আমি। পেছন থেকে দুই গুর্খা এসে মাস্টারদাকে কোমড়ে জড়িয়ে ধরে ফেলল, মাস্টারদা ধরা পড়লেন। স্থানীয় এক ভদ্রলোক সন্দেহ ক'রে আশ্রয়স্থলের খবর পুলিসকে দেয়। সেই ভদ্রলোকও বাঁচতে পারেনি বেশী। দিন। মাস্টারদার ফাঁসির ১০ দিন আগে তাকে হত্যা করে মাস্টারদাকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ নেওয়া হয়। জনসাধারণ জানত, পুলিসের লোকও জানত, হত্যাকারী কে; কিন্তু ধরবার জন্য সাক্ষী সাবুদ মেলেনি।

মাস্টারদা ছিলেন খুবই কড়া ও সাবধানী। আমার পলাতক জীবনের প্রথম দিনের একটি ঘটনা। এক বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছি, আশ্রয়দাতার এক ছেলে মাস্টারদাকে খাওয়াবার জন্য অন্য এক বাড়ীর পাঁঠা চুরি করে নিয়ে আসে। মাস্টারদা ঘটনাটি জানতে পেরে ছেলেটিকে ডেকে অসম্ভব বকে দিলেন এবং সেই রাত্রেই আশ্রয় ছেড়ে চলে এলেন। ছাগল চোরের খোঁজ করতে এসে আমাদের খোঁজ পাওয়া বিচিত্র নয়।

কিন্তু পলাতক জীবনের শেষ দিকে মাস্টারদা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, বলতেন। "আমার মনে হয় এখন একটু বেশী শিথিল হয়ে পড়েছি'। আমরাও দেখতাম, মাস্টারদা দেখা সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে আগের মতো আর কড়া ছিলেন না, যে আসত তারই সঙ্গে দেখা করতেন। ছেলেদেরও দেখতাম কেউ কেউ চুরি ক'রে বিড়ি সিগারেট খায়। মাস্টারদা মাঝে মাঝে বলতেন 'এবার আমার পালা শেষ হয়েছে। কিন্তু কারণ কি ঠিক বুঝতে পারতাম না। শেষের দিকে মাস্টারদা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস, তাঁর চিন্তাধারার ক্রমবিকাশ লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি বলতেন : ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদের কাজে লাগবে। লেখা তাঁর শেষ হয়নি, অসমাপ্ত লেখাগুলিও পুলিশের হাতে গিয়ে পড়েছে।

মাস্টারদা ধরা পড়ার তিন মাস পরে ধরা পড়ি আমরা, আমি ও তারেকশ্বর দস্তিদার। বিচার হয় আমাদের তিনজনেরই এক সঙ্গে। জেলে গিয়েও দেখি মাস্টারদা চুপ ক'রে নেই। তিনি জানতেন, তাঁর ফাঁসি সুনিশ্চিত, তাই তিনি সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দিতেন তারকেশ্বর দস্তিদারকে কাঠগড়ায় ব'সে। তাঁর ধারণা ছিলতারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হবে না। শুধু কাঠগড়ায় বসে নয়, জেলের ভেতরও। জেলের ভেতর মিলিটারী পাহাড়ায় ছিলেন তাঁরা দুজন, জেল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নয়। প্রহরীরা রাত্রে জেলের দরজা খুলে দিত। মাস্টারদা গুর্খা প্রহরীদেরও বশ করে ফেলেছিলেন। মাস্টারদা আমাকে একদিন বলেছিলেনজেল থেকে বেরিয়ে এসে শহীদদের জীবনী প্রকাশ করবার চেষ্টা করি যেন আমরা। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও তাদের কথা তিনি ভুলতে পারেননি।

ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল ১৯৩৩-এর ১৪ই আগষ্ট দু'জনেরই। মাস্টারদা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন: "আমরা হাইকোর্ট করব, প্রিভি কাউন্সিল করব, তা ছাড়া ফাঁসির আগে তোর সঙ্গে দেখা করবই।” শাস্তির পরেই আমাকে চাটগাঁয়ের বাইরে নিয়ে যায়। দেখা আর হয়নি। ১৯৩৪-এর ১২ই জানুয়ারী মাস্টারদার ফাঁসি হয়। ফাঁসির সময়ও জানতে পারিনি। বহুদিন পরে রাজশাহী জেলে ব'সে চাটগাঁয়ের ছেলেদের মুখে শুনি—সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ক'রে রাত বারোটায় দিয়েছে ফাঁসি। মৃতদেহ আত্মীয় স্বজনকেও দেওয়া হয়নি। মাস্টারদা আমাদের জন্য বাণী রেখে গেছেন : “আমার অসমাপ্ত কাজের ভার তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম, এগিয়ে যাও, বন্ধুগণ, এগিয়ে যাও।"

মাস্টারদাদের ফাঁসি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তবু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম রাজশাহী জেলে ব'সে : 'তোমার আদর্শ বহন ক'রে নিয়ে আমরা চলব।'

১৯৩৯ সালের মে মাসে জেল থেকে ফিরে এসেছি। এক ফেরীওয়ালা বলল : সূর্য সেনের যেদিন ফাঁসি হয় সেদিন সূর্য ওঠেনি। অশিক্ষিত মনের মাস্টারদার প্রতি গভীর অনুরাগ এই ক'টি কথার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরিয়েছিল।

যে-গ্রামে মাস্টারদা ধরা পড়েছিলেন সেই গৈরলা গ্রামেই জাপ-বিরোধী প্রচারের সময় মুসলমান পাড়ার একজন বলেছিলেন: আমরা কি ভেন্ডার জাত (মুসলমানরা হিন্দুকে চাটগাঁয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে ভেন্ডা বলে) যে জাপানীর পক্ষে যাব? ঐ ডেণ্ডারাই সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ডেভাদেরই বিশ্বাস নেই। ঐ ডেণ্ডা সুভাষ বোস তো গেছে জাপানে।"

চট্টগ্রামের জনসাধারণ মাস্টারদাকে এখনও ভুলতে পারেনি, কিন্তু যারা ছিল এতদিন দৃশ্য-নগণ্য, তারা আজ সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মজুতদার, চোরাকারবারী, কন্ট্রাক্টরযারা দুঃস্থ মেয়েদের নিয়ে আজ ব্যবসা চালায়। আমরা, যারা সূর্য সেনের সঙ্গে কাজ করেছিলাম, সেই সূর্য সেনের চট্টগ্রামের এই দুর্দশা দেখে লজ্জিত হই। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, যে-সংগ্রাম সূর্য সেন আরম্ভ করেছিলেন। সে-সংগ্রাম আমরা চালিয়ে নিয়ে যাব। আমরা জানি চট্টগ্রামের জনসাধারণ তাঁকে এখনও স্মরণ করে, চট্টগ্রামের জনসাধারণ এই ঐতিহ্যের সম্মান বজায় রাখবার কাজে আমাদের এখনও সাহায্য করে।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের স্মৃতিকথা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে।

সূত্রে : মার্কসবাদী পথ

 

Comments :0

Login to leave a comment