SACHAR REPORT

ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে ফেরাতে হবে সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্য

রাজ্য কলকাতা

md salim cpim sachar committee bengali news আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম। ছবি প্রতিকী।

সাচার কমিটির সুপারিশ নিয়ে আলোচনায় উঠে এল উদ্বেগের নতুন বিষয়। ভারতের মুসলিমদের অনগ্রসরতা দূরীকরণের পদক্ষেপ তো পরের কথা, মুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা এবং অর্জিত অধিকারগুলি নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি? কলকাতায় হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই উদ্বেগ প্রকাশ করে জানালেন, কেবলমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পরিবেশকে ফিরিয়ে এনেই ফের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে আলোচ্য বিষয় হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে। 

১৭ বছর আগের সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে একসময়ে অনেক হইচই হয়েছিল রাজনৈতিক মহলে, সংবাদ মাধ্যমেও। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই রিপোর্টের তথ্য ঘিরে মুসলিমদের মধ্যে বিতৃষ্ণা তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে। কিন্তু তারপর? কেন্দ্রের সরকার পালটেছে, রাজ্যেও সরকার পালটেছে। যাঁরা কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাচার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে হইচই করেছিলেন, তাঁরা চুপ করে গিয়েছেন। কিন্তু কেন? 


এই পরিস্থিতিতে কলকাতার হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশন ‘সাচার কমিটি এবং ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম প্রসঙ্গ’ বিষয়ে দু’দিনের একটি জাতীয় পর্যায়ের সেমিনার শুরু করেছে শনিবার। আশুতোষ মেমোরিয়াল হলে শনিবার সন্ধ্যায় এর উদ্বোধন করেন রাজ্যসভার প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে রহমান খান। সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা উপপ্রধান ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরুদ্দিন শাহ, বিহারের প্রাক্তন মন্ত্রী শাকিলউজ্জামান আনসারি উদ্বোধনী পর্বে এই প্রয়োজনীয় বিষয়টি নিয়ে সেমিনার সংগঠিত করার হিম্মৎ দেখানোর জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন উদ্যোক্তাদের।

মহম্মদ সেলিম বলেছেন, দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাম সমর্থিত প্রথম ইউপিএ সরকারের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সাচার কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, যা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচীতে ঘোষণা করা হয়েছিল। কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তা নিয়ে তখন অনেকে চিৎকার করেছিলেন, রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা আজ চুপ করে গিয়েছেন কেন? সাচার রিপোর্ট নিয়ে চর্চাই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেন? কারণ দেশ এবং রাজ্যের আবহাওয়াই বদলে গিয়েছে। যে কোনও সমাজে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য নিশ্চিত করতে হয় তাদের পরিচিতি, নিরাপত্তা এবং সমতাকে। আজকের দিনে এর সবকটাই আক্রান্ত। তাই উন্নয়ন চাইলে সবার আগে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে মজবুত করতে হবে। 


অন্যথায় পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে কী ঘটে, তার উদাহরণ দিয়ে সেলিম বলেন, বামফ্রন্ট সরকার সাচার কমিটির দেখিয়ে দেওয়া উন্নয়নের ঘাটতিগুলি দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছিল। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ আসা মাত্র সবার আগে ওবিসি ক্যাটেগরিতে ১৫ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। আর আজ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রাপকদের ১৭৩ জনের তালিকায় মাত্র এক জন সংখ্যালঘু! রাজ্যে যে ৮ হাজার স্কুল বন্ধ করা হচ্ছে, সেগুলো তো বেশিরভাগই সংখ্যালঘু-প্রধান এবং এসসি-এসটি প্রধান এলাকায়। মুসলিম ছাত্রীদের জন্য রায়গঞ্জে যে হস্টেল তৈরি করা হয়েছিল, তার ভবনেই এখন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়।

 কলকাতায় উর্দুভাষী এলাকার স্কুলগুলির আপগ্রেডেশনের টাকায় শহরে টয়লেট বানানো হচ্ছে! আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বামফ্রন্ট সরকার বানিয়েছিল, এখন সেটা ধংস করে পার্ক সার্কাসের দামী জমি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতে চাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান— এই ধারণাকে চুরমার করে খাদ্য, পোশাক, ভাষায় অভিন্নতা চাপানো হচ্ছে। 


এদিন ভার্চুয়ালি সেমিনারের উদ্বোধন করে কে রহমান খান বলেন, সাচার কমিটির সুপারিশ রূপায়ণের জন্য ইউপিএ সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল, তার ৪০ শতাংশের বেশি কাজও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকার আর এই বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। জামিরুদ্দিন শাহ বলেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নকে যাঁরা সংখ্যালঘু তুষ্টিকরণ বলেন, তাঁরা আসলে ভোটের হিসাব কষেন। কই সংখ্যাগুরুদের বেলায় তো এমন শব্দ ভাবা হয় না! তিনি মুসলিমদের অনগ্রসরতা দূর করার জন্য মুসলিম সমাজকেও এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে জাকাৎ এবং ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। 

শাকিলউজ্জামান আনসারি বলেন, সাচার কমিটি রোগ নির্ধারণ করেছে। রোগ সারাতে সরকারি তরফে যে উদ্যোগ দরকার, সেটা ইউপিএ সরকার নিয়েছিল। কিন্তু এখন কেন্দ্রের সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো বিভিন্ন রাজ্যের সরকার সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সময় হয়েছে। 

দু’দিনের এই সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সমাজকর্মী শায়রা শাহ হালিম। স্বাগত ভাষণে হাসিম আবদুল হালিম ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ডা. ফুয়াদ হালিম বলেন, সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ নিয়ে যে চর্চার প্রয়োজন, তা এই সেমিনারের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২০ জন স্কলার এই সেমিনারে যোগ দিচ্ছেন। 


এদিন সেমিনারের উদ্বোধনী পর্বেই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিশিষ্ট সৈনিক এবং বামপন্থী আন্দোলনের নেতা প্রয়াত হাসিম আবদুল হালিমের উপরে একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র দেখানো হয়, যিনি টানা ২৯ বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর নামাঙ্কিত ফাউন্ডেশনই সেমিনারের আয়োজক। রবিবার সেমিনারের পরবর্তী পর্বগুলি অনুষ্ঠিত হবে ভারতীয় ভাষা পরিষদ ভবনে।

Comments :0

Login to leave a comment