রুহুল আমিন গাজী
মুসলমান সমাজে ওয়াকফ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক সূত্রে ওয়াকফের শুরু হজরত মহম্মদের সময় থেকেই। বুকারি হাদিস মতে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হাদিস দ্বারা। স্থাবর-অস্থাবর উভয় সম্পত্তি ওয়াকফ হতে পারে। ওয়াকফ দুই প্রকার। একটা হচ্ছে ওয়াকফল-লিল্লাহ অর্থাৎ পাবলিক ওয়াকফ বা জনসাধারণের ওয়াকফ যার আয় বা উৎপন্ন সামগ্রী জনস্বার্থে বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান হিসাবে ব্যবহৃত হবে। অন্যটি হচ্ছে ওয়াকফলা-আউলাদ। যার অর্থ হলো ব্যক্তিগত ওয়াকফ যার আয়ের একটা অংশ বা উৎপন্ন সামগ্রী দাতার পরিবারের মধ্যে বণ্টিত হবে এবং অপর অংশ জনস্বার্থে ব্যবহৃত হতে হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি উৎস্বর্গ হবে চিরস্থায়ী। একবার ওয়াকফ হলে সেই সম্পত্তি ফেরত নেওয়া যাবে না। যেমন ঘুটিয়ারী শরীফে সৈয়দ মোবারক গাজী পবিত্র মাজারের সম্পত্তি হলো লা-লিল্লাহ। অর্থাৎ পাবলিক সম্পত্তি ও জনগণের সম্পত্তি। কোনও পরিবার বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
ওয়াকফ আইন:
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওয়াকফ অ্যা ক্ট ১৯৫৪ সালে ভারতের পার্লামেন্ট দ্বারা পাশ হয়। প্রয়োগ কালে অসুবিধা দুর করার জন্য এই আইন ১৯৫৯, ১৯৬৪, ১৯৬৯ সালে সংশোধন হয়। ১৯৭০ সালে ওয়াকফ অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয় এবং এই সমিতি সুপারিশ অনুসারে ১৯৮৪ সালে একটি সংশোধনী ওয়াকফ অ্যা ক্ট ১৯৮৪ পাশ হয়। এই আইনেরও বহু আলোচনা-সমালোচনা ছিল। এই আইন জম্বু-কাশ্মীর ছাড়া সারা দেশে প্রযোজ্য। কেন্দ্রের মোদী সরকার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান ওয়াকফ আইনের সংশোধন করতে চাইছে। এর তীব্র বিরোধিতা করেছে পশ্চিমবঙ্গ আওয়াজ রাজ্য কমিটি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংবিধানের মূল ভাবনার বিরোধী।
কেন্দ্রের এনডিএ সরকার গত ৮ আগস্ট, ২০২৪ ওয়াকফ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেছিল। ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইনের যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নতুনভাবে ওয়াকফ আইন তৈরি হয়েছিল। ১৯১৩ সালে আরও কিছু সংশোধনী যুক্ত হয়। বর্তমানে সারা দেশে নথিভুক্ত কমবেশি সাড়ে আট লক্ষের মতো ওয়াকফ সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত অর্থ জনগণের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়। বর্তমানে বিজেপি সরকার ওয়াকফ আইনের উপরে ৪০টির সংশোধনী এনে ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকার কর্তৃত্ব বাড়াতে চাইছে। বর্তমানে যে আইন আছে, তাতে ওয়াকফের দখলে থাকা জমি বা সম্পত্তিতে অধিকার ওয়াকফ বোর্ডের, তারাই একমাত্র এই সম্পত্তির পর্যালোচনা করতে পারবে। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগ নেই। এই ব্যবস্থা পালটাতে চাইছে মোদী সরকার। অর্থাৎ আগামী দিনে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ড নিজেদের বলে দাবি করলে তা বাধ্যতামূলক পর্যালোচনা করবে সরকার। এই অর্থে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি খতিয়ে দেখার ও খবরদারি করার আইনি ক্ষমতা কেন্দ্রের সরকার নিজের হাতে রাখতে চাইছে। শুক্রবার সংসদে এই বিলের বিরুদ্ধে ‘ইন্ডিয়া' মঞ্চের সাংসদরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। সরকার বাধ্য হয়েছে বিলটি পর্যালোচনায় যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করতে। তবে কমিটিতে নিজের জোটের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রেখেছে। বামপন্থী সাংসদদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাও আমরা আশা করি, যৌথ কমিটি সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করবে।
এই প্রসঙ্গে ‘আওয়াজ’দাবি করছে, সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির কম্পিউটার নথিভুক্ত করতে হবে এবং কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির যেন বে-আইনি হস্তান্তর কিংবা শাসক দলের কর্মীদের মদতে জবরদখল না হয়। ওয়াকফ সম্পত্তির অর্থ যেন সংখ্যালঘু উন্নয়নেই ব্যয় করা হয়।
ওয়াকফ বোর্ডের কাজ ও ক্ষমতা:
ওয়াকফ বোর্ড কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নয়। ওয়াকফ বোর্ড হলো ধর্ম নিরেপেক্ষ একটি আইনি সংস্থা। যার দায়িত্ব আইন দ্বারা নির্ধারিত করা হয়েছে। ওয়াকফ বোর্ডের কাজ ও ক্ষমতা আইনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যেমন সমস্ত ওয়াকফের রেকর্ড রাখা হয়। সমস্ত বোর্ডের অধীন সব ধরনের কর্ম-কর্তাদের কার্যকলাপ আয়-ব্যয়ের উপর নজর রাখা, তাদেরকে প্রশাসনিক নির্দেশ দেওয়া, ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা রচনা করা, ওয়াকফের বাড়তি আয় কিভাবে ব্যয়িত হচ্ছে তার খোঁজ-খবর নেওয়া, তাদের বাজেট পরিকল্পনা সঠিক নির্দেশ করা। অযোগ্য দুর্নীতিগ্রস্ত কর্ম-কর্তাদের পদচ্যুত করা, ওয়াকফের স্বার্থ রক্ষায় মামলা করা, বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সম্পত্তির চরিত্রের পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া, ওয়াকফ তহবিলে দেখাশুনা করা, কর্ম-কর্তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া ও তদন্ত করা এবং ওয়াকফ সম্পত্তি সার্ভে ও চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি কাজ ওয়াকফ বোর্ড করতে পারে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য চিফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার থাকবেন। যিনি রাজ্য সরকারের দ্বারা প্রথম শ্রেণির অফিসার। তিনি ওয়াকফ বোর্ডের কাজ পরিচালনার ব্যপারে মুখ্য বা প্রধান ভূমিকা পালন করবেন।
ওয়াকফের সমস্যা:
ওয়াকফ বোর্ডের অধীন বোর্ড নিয়োজিত বেশিরভাব কর্ম-কর্তাগণ সম্পত্তি থেকে যা প্রকৃত আয় হয়, তা গোপন করে কম দেখায়। বেশ কিছু বড় বড় মাজারের বহু মূল্যবান সম্পত্তি আছে। কিন্তু বোর্ডের উদাসীনতায় কর্ম-কর্তাদের সমাজ চেতনার অভাব এবং সম্পত্তি ব্যবহারের সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে বেশির ভাগ সম্পত্তি বে-আইনি জবর-দখল হয়ে আছে। অথবা দেখাশোনার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওয়াকফ সম্পত্তি জবর-দখল, আত্মসাৎ ও বিলোপ সাধন গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বহু স্থানে অসৎ কর্ম-কর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের সাহায্যে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে। ভূমি আধিকারিকের সাহায্য নিয়ে বহু সম্পত্তি অনেক কর্ম-কর্তারা হয় নিজের বা পরিবারের নামে রেকর্ড করে নিয়েছে বা বিক্রি করে দিয়েছে। রক্ষক যথার্থ ভক্ষক হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওয়াকফের খুবই ক্ষতি করেছে। তাই ওয়াকফের ইচ্ছানুসারে মুসলিম সমাজের উন্নয়নের কাজ সফল হয়নি। সম্পত্তির লোভ, আইনের জটিলতা, আদালতের দীর্ঘ শত্রুতা মুসলিম জনগণের অজ্ঞতা, প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং সমাজের দুর্নীতিপরায়ণতা এসব ওয়াকফের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে বাধার সৃষ্টি করে। কিছু স্বার্থান্বেষী মুসলিম ব্যক্তি মহৎ, সৎ, ধার্মিক, নিষ্ঠাবান মুসলিমদের দান করা সম্পত্তি আপন স্বার্থে কাজে লাগিয়ে বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ওয়াকফ বোর্ডের কাজ সংগঠিত ও পরিকল্পনা মাফিক চলে না। বোর্ডের হস্তক্ষেপ যথেষ্ট শিথিল ও দুর্বল। বোর্ডের কর্মচারীদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের জন্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণের সঠিক সময়ে হস্তক্ষেপ হয় না । ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা করা এবং তার দলিল রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করার ব্যাপারে গুরুতর গাফিলতি ও চরম উদাসীনতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
ওয়াকফের অর্থে সঠিক উন্নয়ন:
ওয়াকফের সম্পত্তিতে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং পরিকল্পিতভাবে মুসলমান সমাজে উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব। বেশকিছু মহৎ, সৎ ও ইসলাম ধর্মে নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা আল্লার উদ্দেশ্যে সম্পত্তি দান করেছেন। বা ওয়াকফ করেছেন। এই সম্পত্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মুসলিম জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান ও পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু এলাকায় বিদ্যুৎ, পানীয়জল, রাস্তাঘাট, বহুবিধ সামাজিক উন্নয়নে ব্যবহার হতে পারে। এই ওয়াকফের অর্থে— ছাত্রাবাস, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। গরিব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তাদান কর্মসূচি হতে পারে। গরিব মুসলিম মহিলাদের জন্য সহায়তামূলক কর্মসূচি গড়ে উঠতে পারে। এই সমস্ত সমস্যা দুর করতে গেলে সার্বিক ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার। এব্যাপারে মুসলিম সমাজের মধ্যে সচেতন অংশকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। গত ২৫-২৭ অক্টোবর, ২০০২ সালে রাজস্থানের জয়পুরে ওয়াকফ সমস্যা নিয়ে একটি তিনদিনের সম্মিলিত সম্মেলন হয়েছিল এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিরা তাতে অংশগ্রহণ করেন। আলোচনার পর ঐ সম্মেলন থেকে কিছু সুপারিশ গৃহীত হয়েছিল যা নিম্নরুপ:-
১) ওয়াকফ সম্পত্তি সুরক্ষা, বিকাশ এবং প্রগতির জন্য মুসলিম সমাজের চেতনার খুবই প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
২) ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহারে পদ্ধতির সংস্কার চাই এবং সেই কাজে সমগ্র মুসলিম সমাজের সহযোগিতা নিতে হবে।
৩) ওয়াকফ সম্পত্তি সমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত দলিলপত্র অনুসন্ধান করতে হবে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে সেসব সংরক্ষণ করতে হবে।
৪) ওয়াকফ সম্পত্তি সার্ভে করার কাজে সমগ্র জনগণের সাহায্য নিতে হবে এবং সঠিক সময়ে এগিয়ে আসার জন্য মুসলিম সমাজকে আবেদন করতে হবে।
৫) ওয়াকফ সম্পত্তির সমস্ত নিয়ম-কানুন একত্রিত করে, সেসব বিশ্লেষণ করে তাকে আরও কার্যকর করতে সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সে ব্যাপারে রাজ্য-কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
৬) ওয়াকফের আয়, ফি ইত্যাদি সম্পর্কিত ব্যাপারে নিয়মিত অনুসন্ধান করতে হবে।
৭) ওয়াকফ সম্পত্তি পঞ্জিকরণ বর্তমান পদ্ধতির আলোচনা করা এবং সমাজ কল্যাণে প্রয়োজনীয়তাকে মনে রেখে এর উপযুক্ত সংস্কার সাধন করতে হবে।
৮) ওয়াকফ সম্পত্তিকে উদ্ধারের জন্য পরিকল্পিতভাবে অভিযান চালাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯) ওয়াকফ সম্পত্তির আয়ের সামগ্রিক বৃদ্ধির জন্য বিশেষ পরামর্শ মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০) ওয়াকফ সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ গভীরভাবে বিচার করে তার উপর কর্মসূচি নিতে হবে।
১১) ওয়াকফ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা ঐ ধরনের আর্থিক সংস্থা প্রচেষ্ঠা চালাতে হবে।
১২) দেশে একটা ন্যাশানাল ওয়াকফ্ ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক স্থাপন করার প্রচেষ্ঠা চালাতে হবে।
১৩) এমন ভাবে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে চালানো দরকার যাতে শিক্ষাগত, সমাজিক, আর্থিক বিকাশ হয় এবং ওয়াকফ সমাজ কল্যাণের জন্য যাতে একটা নিয়মিত মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে।
১৪) স্থানীয় স্তরে কমিটি গঠন যাতে সব কাজ ঠিকভাবে দেখাশুনা করা যায় এবং ওয়াকফ ব্যবস্থা দুর্বল ও গরিব মানুষের জন্য শক্তি জোগাতে পারে।
উপরোক্ত সুপারিশগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় ৷
Comments :0