অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতি ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ বাঁচাতে পরিকল্পনার শেষ নেই। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন মানুষ নিয়ে তেমন হেলদোল কই! জলবায়ু কিংবা প্রকৃতি, যে কোনও প্রাকৃতিক পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ গরিব মানুষ। তাঁদের পেশাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জীবন-জীবিকার সঙ্গে লড়াই করতে করতে একদিন ভিটেবাড়ি ছেড়ে অনেককে ভিনদেশি হতে হয়। তখন আরও বেড়ে যায় জীবন সংগ্রাম। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সুন্দরবনে সেই সমস্যা এখন প্রকট হচ্ছে।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। বিদেশি সংস্থার অর্থে পুষ্ট সে সব গবেষণা চলেছে। কিন্তু সুন্দরবনের মানুষ যে তিমিরে ছিলেন, এখনও সেখানেই থেকে গেছেন। প্রাকৃতিক কারণে জমি হারিয়ে অনেক মানুষ ইতিমধ্যে উদ্বাস্তু। সরকার সেই হিসাব রাখে না। প্রতিকূল জলবায়ুর জেরে ঘরছাড়া কথা আসতে সরকার মনগড়া অঙ্ককে সামনে আনে। সুন্দরবনে নাকি জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৩০০০। বিকল্প পেশার খোঁজ দেওয়া দূর, উন্নয়নের নামে এখনও সুন্দরবন ধ্বংস করা হচ্ছে। উন্নয়নের স্থিতিশীলতা যাচাই না করে লাগাতার সুন্দরবনকে বদলে ফেলার জেরে ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে সেখানকার মানুষের জীবিকা।
সম্প্রতি জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চে ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সুন্দরবনে মানবিক ও জীবনযাপনে প্রভাব’ সম্বন্ধীয় আলোচনাচক্রে বিশেষজ্ঞরা সময়োপযোগী কিছু বিকল্প পেশার সন্ধান দিলেন। আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক তুহিন ঘোষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পুনর্বসু চৌধুরি ও বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক সুগত হাজরা। সভাটি পরিচালনা করেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ চক্রবর্তী। সুন্দরবন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বক্তারা কিছু লাভজনক পেশার সন্ধান দেন।
সুন্দরবন সমস্যা নিয়ে কথা উঠতেই নদী বাঁধের ভাঙন বেশি প্রাধান্য পায়। আলোচনায় বারবার আসতে থাকে ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন ধ্বংস। কিন্তু অধ্যাপক তুহিন ঘোষের মতে, সুন্দরবনের সমস্যার মূল কারণ সেখানকার নদী প্রবাহ নষ্ট হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের মেঘনা নদীর অবস্থা ভালো থাকার জেরে সেখানকার বাসিন্দারা এখনো তাঁদের জীবিকাকে সুন্দর চালিয়ে নিতে পারছেন, যেটা এই বঙ্গে হচ্ছে না। মধু সংগ্রহের জন্য মৌলিদের পাশাপাশি পড়শি দেশে পাতা সংগ্রহকারী বাউলেরা এখনো অর্থকরী গোলপাতা সংগ্রহ করতে পারছেন। জলে লবণাক্ততা বাড়ায় এবঙ্গে গোলপাতা গাছ বিরল। নদী বাহিত পলি প্রাকৃতিক নিয়মে আর লবণাক্ততাকে কমাতে পারছে না। ফলে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার স্বাভাবিক উদ্ভিদকুল।
সুন্দরবন জলজ বাস্তুতন্ত্র নির্ভর। স্থলজ বাস্তুতন্ত্র নয়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন ১৯টি ব্লকের ১৩টি ব্লক দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আর ৬টি ব্লক উত্তর ২৪ পরগনায়। সুন্দরবনকে বাঁচাতে সব সময় গাছ রোপণ গুরুত্ব পায়, সেখানকার নদীর প্রবাহমানতা নিয়ে কাজ করাটা যে সবচেয়ে আগে করা দরকার, তা নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। অধ্যাপক ঘোষের মতে, সুন্দরবনে ক্রমশ কমে আসছে স্বাদু জলের ভাণ্ডার। সুন্দরবনে বৃষ্টি হলেও বছরে বর্ষার দিন কমে যাচ্ছে। স্বাদু জলের প্রাপ্যতা নিম্নমুখী হলে বর্ষার জল ধরার কোনও ব্যবস্থা নেই। তার ওপর ঠাকুরণ, সপ্তমুখী নদীর অস্তিত্ব নেই। শহরতলির পৌরসভার বর্জ্য বইতে গিয়ে বিদ্যাধরী নদী দূষিত, প্রবাহ থেমে আসছে।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণায় এখনও ১০২টি দ্বীপকে গণ্য করা হচ্ছে। অথচ সাগরদ্বীপ সংলগ্ন লোহাচরা, বেডফোর্ড ও ল্যাসদ্বীপ ভেঙে তলিয়ে গেছে। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে ঘোড়ামারা দ্বীপ। ঘোড়ামারার কাছেই হলদি নদীর মোহনায় আবার নদীর পলি জমে জেগে উঠেছে নয়াচরের নতুন ভূখণ্ড। প্রকৃতির এই ভাঙাগড়ার মাঝে পড়ে সেখানকার মানুষের জীবন ক্রমশই দুর্বিষহ হচ্ছে। তার ওপর নদীর চরে চলছে বেআইনি নির্মাণ। অভিযোগ, সুন্দরবনে ‘কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট’-এর নিয়মকানুনও মানা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে আমল দিচ্ছে না প্রশাসন। গাছ লাগিয়ে শুধু উপকূল রক্ষার চেষ্টা চলছে। অথচ মিন ধরতে গিয়ে যে মাইলের পর মাইল নদী পাড় ভাঙছে, সে খবর কে রাখে।
সুন্দরবন মানে জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। এই নিয়েই সংসার সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের। কৃষিকাজের পাশাপাশি জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করা, নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরাটা স্থানীয় মানুষদের প্রধান জীবিকা। বিপদ সঙ্কুল সে কাজ করতে গিয়ে প্রায়শই বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিতে হয়। বাঘ কিংবা কুমিরের আক্রমণ এড়াতে তাই প্রয়োজন বিকল্প কর্মসংস্থান। সেই কাজের খোঁজ হতে হবে সেখানকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবন উপযোগী। আর সেই সব কাজের খোঁজে অনেক এখন গবাদি পশু পালন করে দুগ্ধ সামগ্রী তৈরির সমবায় গড়েছেন তো কেউ বাক্স মধুকে পেশা করতে চাইছেন। জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের মানুষ খুব সহজেই এই বাক্স মধু জীবিকা হিসাবে নিতে পারেন।
এই বিষয়ে আলোচনাসভায় বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পুনর্বসু চৌধুরি। তিনি জানান, মধু সংগ্রহ আর কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বিপদ বেশি আসে। তাই এখন রক্তবিহীন মধু প্রস্ততিকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বাক্সতে ভালোই মধু করা যায়। এর মানও ভালো হয়। বন দপ্তরের সব ফরেস্ট ক্যাম্পে সেই মধু তৈরির বাক্স বসিয়ে স্থানীয়দের সেই পথে চলতে উৎসাহিত করছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সুন্দরবনের মধুর বাজারদর বাড়াতেও তিনি পথ দেখিয়েছেন। অধ্যাপক চৌধুরি জানান, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধুর তুলনায় বাক্সে একক ফুলের মধু উৎপাদন করলে তার বাজার দর অনেকটা বাড়ে। ঝুঁকি এড়িয়ে ভালো লাভ পাওয়া যায়। আসলে জঙ্গলের চাক ভাঙা মধু সংগ্রহের পদ্ধতিগত ত্রুটিতে তার মান কমে যায়। চাক চেপে মধু নিষ্কাশনের সময় মৌমাছির লার্ভার তরল চলে আসে। এতে মধুর মান কমে।
অথচ যদি কোনোভাবে একক ফুলের রেণু থেকে মধু তৈরি করা যায়, তাহলে তার দাম মেলে সাধারণ মধুর কয়েক গুণ। সুন্দরবনে এমনিতেই খলসি মধু’র জনপ্রিয়তা রয়েছে। এমনইভাবে গরান, কেওড়া ফুলের মধু করা যেতে পারে। নিউজিল্যান্ডের ‘মানুকা হানি’ যদি পুষ্টিগুণে বিশ্বব্যাপী জায়গা করে নিতে পারে তাহলে সুন্দরবনের একক ফুলের মধু তা পারবে না কেন। বাজারে এক কিলোগ্রাম মানুকা মধুর দাম ছয় হাজার টাকা। মধুর পাশাপাশি সংগ্রহ করা যেতে পারে চাকের নিচে পড়তে থাকা ‘বি পোলেন’। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ‘বি পোলেন’-এর বাজার দর ভালো। চাহিদাও প্রচুর। মধু তৈরির পাশাপাশি পুকুর ছাড়া কাঁকড়া চাষও বিকল্প আয়ের সন্ধান দিতে পারে।
ঘরেই করা যেতে পারে কাঁকড়া চাষ। অধ্যাপক চৌধুরি জানান, ছোট কাঁকড়াকে পুকুরে ফেলে কিংবা ঘরে প্রকোষ্ঠ করে খাদ্য-খাবার খাইয়ে বড় করে বাজারজাত করা যায়। সারা বছর এই বড় কাঁকড়ার চাহিদা থাকে। এই পদ্ধতিকে বলে কাঁকড়া পুষ্টিকরণ বা ক্রাব ফ্যাটেনিং। সুন্দরবনে হাতেগোনা দু’একজন এটা করতে পারছেন। সুন্দরবনের পরিবেশে এই চাষের উদ্যোগে একটা নিশ্চিন্ত আয়ের রাস্তা দেখাতে পারে। এর বাদে যাদের ছোট পুকুর বা ডোবা রয়েছে সেখানে করা যায় ‘কেক ফিশারি’। গোলাকৃতি জালের মধ্যে ছোট মাছকে সহজে বড় করা যায়। এতে মাছ সংগ্রহের খরচও কমে। ইচ্ছামত তা বিক্রি করা যায়। সুন্দরবনের সর্বত্র মাশরুম চাষ করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পে ‘গাইড’-এর চাহিদাও বাড়ছে।
পুকুরের মধ্যে কাঁকড়াকে বাক্সবন্দি ‘ক্রাব ফ্যাটেনিং’ করতে গেলে একটু প্রযুক্তিগত সহায়তা লাগে। কাঁকড়াদের কাঁচা মাছ নির্দিষ্ট মাত্রায় খাওয়াতে হয়। সুন্দরবনে দু’-একজন এটা করলেও ব্যবসার ক্ষতির কথা ভেবে তা কাউকে শেখাতে চান না। একই সমস্যা দেখা যায় আর পাঁচটা বিকল্প পেশায় নামার ক্ষেত্রে। এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও জিনতত্ত্ব বিভাগ। সুন্দরবনের সাধারণ মানুষকে পেশাগত সমস্যা কাটাতে চার বিভাগের সংবলিত উদ্যোগে গড়া হচ্ছে ‘জনজীবিকা সহায়তা কেন্দ্র’। কুমিরমারি দিয়ে শুরু করা এই সহায়তা কেন্দ্র ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গায় গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সাধারণ মানুষ পেশাগত সমস্যায় পড়লে বৈজ্ঞানিক সমাধান দেবে এই কেন্দ্র।
সু্ন্দরবন নিয়ে কয়েক দশক গবেষণা চালানো সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক সুগত হাজরা বিকল্প পেশায় জৈবচাষ গুরুত্ব দিতে চাইছেন। জৈব পদ্ধতিতে তৈরি শাক-সব্জির বাজারদর অনেক বেশি। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তা সহজেই শহর ও শহরতলির বাজারে নিয়ে আসা যায়। শহুরে গ্রাহক জৈব চাষে ফলানো সবজিকে কয়েকগুণ দামে কিনতেও আগ্রহী। এতে চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকা সুন্দরবনের প্রচুর মানুষ ভালো লাভের মুখ দেখতে পারেন। সেই সঙ্গে অধ্যাপক হাজরা মনে করেন, এনআরজিএ বা যেকোনও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা সুন্দরবন অঞ্চলে বেশি করে তুলে দেওয়া উচিত।
ম্যানগ্রোভ বসানো থেকে বাঁধ মেরামতি— সব কাজেই সাধারণের মানুষের আয়ের রাস্তা করতে হবে। সুন্দরবনের সমর্থরা অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক হয়েছেন। অধ্যাপক হাজরা মনে করেন, পরিযান আদপে মানুষের একটি অভিযোজন। এটা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। নিজেকে ও তাঁর পরিবারকে ভালো রাখতে পরিযায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করাটা অর্থনতিক বিপর্যয় রুখতে পারে। তবে পরিযায়ীদের জন্য ‘পরিযায়ী সহায়তা কেন্দ্র’ গড়াটা খুব জরুরি। কেননা, অনেকেই বাইরে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়েন। তাঁরা যে কোনও অসুবিধায় পড়লে প্রশাসনিকস্তরে হস্তক্ষেপ করাটাও সহজ হয়। তবে সর্বোপরি ক্ষয়িষ্ণু সুন্দরবনের ৫০ লক্ষ সুন্দরবনবাসীর পেশাগত সুরক্ষায় ‘সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার জেলা’ ঘোষণা করাটা খুব জরুরি।
Comments :0