ক্রেমলিনের ওপর থেকে লাল পতাকা নেমে যেতেই আহ্লাদে আটখানা বিশ্ব পুঁজিবাদ। আর শুধু তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়! পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পূর্ব জার্মানি.... একের পর এক দেশ। তাই না দেখে আনন্দে আত্মহারা মার্গারেট থ্যাচার সোল্লাসে ঘোষণা করলেন 'টিনা'। দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ। অর্থাৎ পুঁজিবাদের কোনও বিকল্প নেই। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বই লিখলেন, ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’। মার্কস এঙ্গেলসের ভাবনার মধ্যে দিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন রাস্তায় পথ চলা শুরু হয়েছিল। লেনিন থেকে মাও জে দঙ, হো চি মিন থেকে ফিদেল কাস্ত্রো যে পথ ধরে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় এনে তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা সুরক্ষিত করে নিশ্চিন্ত রাত্রিযাপন নিশ্চিত করেছিলেন— সেই ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
একইসঙ্গে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির দুনিয়া ঘোষণা করল, ‘মার্কসবাদ মৃত’!
আর তার পর থেকে দু'দিন অন্তর তারা এই ঘোষণা করা অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মধ্যেই তারা মনে করিয়ে দেয় ‘মার্কসবাদ মৃত’।
আচ্ছা, একটা মৃত জিনিসকে কতবার মৃত বলতে হয়? কেন বারংবার মৃত বলতে হয়?
রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ মৃত; গান্ধী-নেহরু-আজাদ মৃত; মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন মৃত। আমরা সবাই তা জানি। কই, কাউকে তো রোজ রোজ সে কথা ঘোষণা করতে হয় না! তাহলে মার্কসবাদের বেলায় ওদের এই ঘোষণা করতে হয় কেন? কারণ আমাদের চেয়েও অনেক অনেক ভালো করে ওরা জানে যে মার্কসবাদ মোটেই মৃত নয়, ভীষণভাবে জীবিত। মানবতার বিরুদ্ধে ওদের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপের সময় মার্কসবাদ চোখ রাঙিয়ে ওদের মনে করিয়ে দেয়: তোমরা অপরাধ করছ। এই অপরাধের হিসাব একদিন মানুষ কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেবে। এই আতঙ্ক ওদের তাড়িয়ে বেড়ায় বলেই দু’দিন অন্তর ঘোষণা করতে হয়, মার্কসবাদ মৃত।
ওরা ভীষণ ভয় পায় লন্ডনের হাইগেট সমাধিতে প্রায় ১৩৯ বছর ধরে চিরনিদ্রায় শুয়ে থাকা মানুষটিকে আর তার মতবাদকে। কারণ এই মতবাদই কমিউনিস্ট ইশ্তেহারের পাতায় প্রথম তুলে ধরেছিল সেই সত্য, ‘‘ইউরোপ ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত।’’ আর এই মতবাদই শাসকের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘‘কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কাঁপুক শাসকশ্রেণি।... সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, জয় করবার জন্য আছে গোটা দুনিয়া।’’
এ হেন বলিষ্ঠ উচ্চারণ পুঁজিবাদের বুকে প্রতিনিয়ত হাতুড়ি পেটা করে। পুঁজিবাদ যে তার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত গলদের কারণে নিজেই নিজের কবর খনন করে চলেছে সেকথাও মার্কসবাদই প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় পুঁজিবাদকে; একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বকেও। কারণ পুঁজিবাদের নিজেকে ‘অপরাজেয়’ বলে দাবি করার ঘোষণা যে ডাহা মিথ্যা একথাও সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে মার্কসবাদই দুনিয়ার সামনে উপস্থিত করে।
টেরি ঈগলটন এই বিতর্কে অংশ নিয়ে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য একটি কথা তুলে ধরেন ‘হোয়াই মার্কস ওয়াজ রাইট’ গ্রন্থে। তিনি বললেন, ‘‘পুঁজিবাদের এই দাবির একটিমাত্র সমস্যা আছে। মার্কসবাদ হলো পুঁজিবাদের সমালোচনা। পুঁজিবাদ সম্পর্কে আজও পর্যন্ত যা যা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অনুসন্ধানী, সর্বাধিক কঠোর এবং সর্বাপেক্ষা ব্যাপক সমালোচনা। এটিই একমাত্র সমালোচনা যা পৃথিবীর বড় বড় ক্ষেত্রকে বদলে দিয়েছে। অতএব যতক্ষণ পুঁজিবাদের কারবার থাকবে ততক্ষণ মার্কসবাদকেও থাকতে হবে। শুধুমাত্র তার প্রতিপক্ষকে রিটায়ার করিয়ে তবেই এই মতাদর্শ রিটায়ার করতে পারে।’’
হাওয়া বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে ভাষ্য। বদলাচ্ছে পৃথিবী। লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭-য় বিপ্লব করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো রাশিয়ায়। গড়ে উঠলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটল যার হাত ধরে তিনি মিখাইল গর্বাচ্যভ। এই গর্বাচ্যভ ১৯৯১-র অর্থাৎ সোভিয়েত পতনের ২৫ বছর বাদে ২০১৬-তে বিবিসি’র সাংবাদিক স্টিভেন রোজেনবার্গকে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, অপরাধ।... পরমাণু অস্ত্রধর একটি দেশে বিপজ্জনক রক্তপাত এড়াতেই সেদিন পদত্যাগ করেছিলাম।’’
সেদিন গর্বাচ্যভকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য। আর, তার ২৫ বছর বাদে গভীর অনুশোচনায় সেই গর্বাচ্যভ দগ্ধ হয়েছেন। কঠোর সমালোচনা করেছেন পশ্চিমী বিশ্বের। আমৃত্যু (৩০আগস্ট, ২০২২) তিনি এই পরিবর্তিত মত নিয়েই চলেছেন।
হেগেলের শব্দবন্ধ ধার করে নিজের বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘এন্ড অব হিস্টরি’। লেখক ফুকুয়ামা এখনও মার্কসবাদকে অপছন্দ করেন। কিন্তু তাঁকেও লিখতে হলো ১৯৯২ সালে আমার লেখা বইয়ে দেখিয়েছিলাম মার্কসবাদী প্রস্তাবনাটি স্পষ্টতই ভুল এবং উদারবাদী গণতন্ত্রের উচ্চতর বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা বিগত ১৫ বছরে উদারবাদী গণতন্ত্রের ভয়ঙ্কর অধোগামিতা দেখেছি। অবশ্য এর পরেও তিনি পুঁজিবাদের পক্ষ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলেন, ‘‘অবশ্য কোনও বিপর্যয় মানেই এই নয় যে তার ভিত্তিভূমি ভুল।’’
এরপর আরও এগারোটা শীত বসন্ত পেরিয়ে গেল। ২০১৮-য় জর্জ ইটনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও তাঁর মত বদলালেন।
ইটন প্রশ্ন করলেন: আপনি কি সমাজতান্ত্রিক বামেদের পুনরুত্থানের কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন? উত্তরে ফুকুয়ামা বললেন: এটা নির্ভর করছে সমাজতন্ত্র বলতে তুমি কী বোঝো তার ওপর। যদি এটা আয় ও সম্পদের চূড়ান্ত বৈষম্যের প্রতিকার হয় তবে সেটা অবশ্যই প্রয়োজন।
৪০ বছর বয়সে ফুকুয়ামা লিখেছিলেন ‘এন্ড অব হিস্টরি’। তখন তিনি পুঁজিবাদের জোরালো সমর্থক ও মার্কসবাদের বিরুদ্ধে। ৫৫ বছর বয়সে লিখলেন পুঁজিবাদের অধোগামিতার কথা। আর ৬৬ বছর বয়সে অনেকটা পৃথিবীকে দেখার অভিজ্ঞতা ও পরিণত প্রজ্ঞার সমাহারে বললেন সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা। ভাষ্য বদলাচ্ছে এবং বদলাবে— এটাই বিজ্ঞান।
বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তক ঐতিহাসিক এরিক হবসবম ‘হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে, ২০০৯ সালে
লিখিত একটি প্রবন্ধে ২০০৮-র আর্থিক মন্দা প্রসঙ্গে লিখলেন, ‘‘প্রচলিত (পুঁজিবাদী) ব্যবস্থাদির
ক্ষয় এমনকি পতনের সম্ভাবনাও এখন আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’’ ২০১০ সালে ‘নিউ লেফট রিভিউ’-কে একটি সাক্ষাৎকারে হবসবম বললেন, ‘‘এঙ্গেলসের প্রতিষ্ঠা করা পার্টিগুলি ইউরোপের সর্বত্র হয় সরকারের মধ্যে এখনও সম্ভাবনাপূর্ণ পার্টি অথবা বিরোধীদের প্রধানতম পার্টি। আমার মনে হয় কোনও এক সময়ে কমিউনিস্টদের পুরানো ঐতিহ্য এমনভাবে পুনরুত্থিত হবে যা আমরা ভাবতেও পারছি না।
হবসবম পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এক দশক আগে। এর মধ্যে অনেক উথাল পাথাল হয়েছে। পুঁজিবাদ মারাত্মক আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। তবুও ইউরোপের অতি উন্নত স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশ ডেনমার্ক, সুইডেন দক্ষিণপন্থা বর্জন করে বাঁ-দিকে মোড় নিয়েছে। মধ্য বামেরা সরকার চালাচ্ছে। একই চিত্র আইসল্যান্ডে, ফিনল্যান্ডে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পালা বদলের পালা। পেরু থেকে মেক্সিকো; আর্জেন্টিনা থেকে বলিভিয়া। কলম্বিয়ার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন দরিদ্র গৃহপরিচারিকা ফ্রাঁসিয়া মার্কেজ। রাষ্ট্রপতি বাম ঘেঁষা গুস্তাভো পেত্রো।
পুঁজিবাদের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করে আমেরিকার জনগণ হারিয়ে দিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ব্রাজিলের জনগণ পরাজিত করল স্বঘোষিত ফ্যাসিস্ত বোলসোনারোকে। জেতালো লুলা দ্য সিলভা-কে। এই প্রতিটি ঘটনাই পুঁজিবাদের শিরদাঁড়ায় শীতল প্রবাহ বইয়ে দেয়। তাই ওরা ভয় পায় মার্কসবাদকে।
পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম আমাদের মনে করিয়ে দেয় মার্কসবাদের বাজার এখন খুব খারাপ। আর এই খারাপ বাজারে ১৫৪ কোটি মানুষ (চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, লাওস ও গণতান্ত্রিক কোরিয়ার সম্মিলিত জনসংখ্যা) সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় বসবাস করে। এই পাঁচটি দেশের সবাই কি সমাজতন্ত্রের সমর্থক? নিশ্চয়ই নয়। আবার এর বাইরে পৃথিবীতে আরো ১৯০ টি দেশ আছে। যেখানে কোটি কোটি মানুষ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্র ও বামপন্থায় আস্থা রাখেন। তার মানে, খুব খারাপ বাজারেও পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ যে মতবাদে বিশ্বাস করে, তাকে যে মানবতার শত্রুরা ভয় পাবে, সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক বললেন, ‘‘আমি মনে করি মার্কসবাদ যেভাবে সমসাময়িক বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছে সেভাবে আর কেউ করেনি। লেনিন বলতেন: মার্কসবাদ সত্য, সেটাই তার শক্তি। আসল কথা হলো এটা যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত আবিষ্কার।’’
এই সত্য ও বিজ্ঞানের পথ ধরেই মার্কসবাদ, নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা ও সমাজতন্ত্রের পথ ধরে শোষণহীন
সমাজ গড়ার সংগ্রাম এগিয়ে যাবে। এগিয়ে যাবেই।
Comments :0