বিচারপতিদের আতঙ্কিত করে নিজেদের পছন্দমতো আদেশ বের করানোর লক্ষ্যে আদালত বয়কটের পথেই হাঁটছে তৃণমূলের আইনজীবীরা। শাসকদলের অনুগামী আইনজীবীদের এই পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালত অবমাননার স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু হয়েছে হাইকোর্টে। বিচার প্রক্রিয়ায় জোর করে বাধা দানের অভিযোগে বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে মঙ্গলবার এই মামলা রুজু হয়েছে। সেই মামলা প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে এদিন বিচারপতি মানথার এজলাস বয়কটের কথা জানিয়ে বার অ্যাসোসিয়েশনের একটি চিঠি প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের হাতে পৌঁছয়। এই চিঠি পৌঁছনো মাত্রই সিনিয়র আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির এজলাসে যান। এজলাসে ওই চিঠির প্রতিবাদ জানাতে বহু আইনজীবী উপস্থিত হন। আইনজীবী ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতিকে বলেন, এভাবে আদালত বয়কট করা যায় না। আদালত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ভট্টাচার্যকে বলেন, আপনারা এনিয়ে মামলা করতে পারেন। তিনি বলেন, বারের এক সদস্য একটি চিঠি দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি এই ঘটনায় বারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এই আদালতের গরিমা রয়েছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের উচিত এব্যাপারে দায়িত্ব নেওয়া। এদিনই বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে যে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়েছে সেই মামলাও প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি মানথা। অন্যদিকে কলকাতা হাইকোর্টে বহু আইনজীবী একত্রিত হয়ে প্রধান বিচারপতির ঘরে আদালত অবমাননার পৃথক একটি মামলার হলফনামা জমা দিয়েছেন।
এদিন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, গোটা তৃণমূল দলটাই আইন এবং যুক্তি মানে না। গুন্ডামির পথে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ে যেতে যায়। এটা একটা পরিকল্পিত ফ্যাসিস্ত প্রয়াস। আদালতের নির্দেশ তাদের পক্ষে না গেলেই বিচারপতিদের অপমানিত করা, আতঙ্কিত করে রাখার চেষ্টা শুরু হয়েছে। শুধু যে সোমবার বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা পোস্টার মেরে বিচারপতির সামাজিক সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে, সেটা নয়। এর আগেও বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী মামলা উঠলে তৃণমূলের আইনজীবীরা এজলাস পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল করেছেন। বিচারপতি চন্দ মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী মামলার শুনানি গ্রহণ করেননি। কিন্তু বিচারপতি এই ঘটনায় ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিলেন। সেই জরিমানার টাকা জমা দিয়েছিল তারা। বিচারপতি দেবাংশু বসাকের বিরুদ্ধে এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তৃণমূল। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলির নির্দেশ হওয়ার সময়েও এই বয়কট-রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিচার ব্যবস্থার ওপর আক্রমণের পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে। বিচারপতিদের অসম্মান এবং আতঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে এদিন কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, বার অ্যাসোসিয়েশন পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির কাছে এজলাস বয়কট সংক্রান্ত যে চিঠি দেওয়া হয়েছে তা ‘‘মিথ্যা চিঠি’’। আমাদের কোনও সভা হয়নি যেখান থেকে এমন প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বারের সভাপতি, সহ সভাপতি বা সম্পাদকের সই নেই। বারের কোষাধ্যক্ষ সোনাল সিনহা ওই চিঠিতে সই করেছেন। তাঁর সই করার কোনও এক্তিয়ার নেই। কীভাবে এই ধরনের রেজিলিউশন নেওয়া হলো তা অনেকেই জানেন না। আইনজীবী ঘোষ বলেন, আদালত বয়কট হবে কেন? কে মামলা শুনবেন? বিচারপতি রাজশেখর মানথার এজলাসে বহু মামলা রয়েছে সেগুলির শুনানি প্রয়োজন।
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের একটি বড় অংশ বিচার ব্যবস্থার ওপর তৃণমূলের আক্রমণের নিন্দা করেছেন। এদিন বহু আইনজীবী প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে এই ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ করার আবেদন করেছেন। আইনজীবী সামিম আহমেদ বলেন, রাজ্যের শাসক দল নিজেদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঢাকতে, অপরাধীদের আড়াল করতে আদালতের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। হাইকোর্টের আইনজীবীরা তৃণমূলের কাজকে ধিক্কার জানাচ্ছে। আদালতের ওপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল আইনজীবীরা রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিন বিচারপতি রাজশেখর মানথা সোমবারের বিশৃঙ্খলা এবং এজলাসে আইনজীবীদের ঢুকতে বাধাদানের ছবি ও ভিডিও দেখেছেন। বিচারপতি মানথা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন এজলাসে ঢুকতে কেউ যাতে বাধা না পান সেদিকে নজর দিতে হবে। এদিন বিচারপতি মানথার কাছে যে হলফনামা জমা পড়েছে সেখানে আদালতে বিশৃঙ্খলার সমস্ত ঘটনার ছবি এবং ভিডিও যুক্ত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির কাছে যে হলফনামা জমা পড়েছে সেখানে বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবের কপি, বিচারপতি মানথার বিরুদ্ধে যে পোস্টার দেওয়া হয়েছিল তার কপি এবং বিশৃঙ্খল আইনজীবীদের ছবি যুক্ত করা হয়েছে।
এদিন এআইএলইউ’র রাজ্য সভাপতি রবিলাল মৈত্র এবং সম্পাদক অরিন্দম ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেন, শাসকদল বিচার ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনাছে। তৃণমূলের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজ্যের সমস্ত আদালতে আইনজীবীদের সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
Comments :0