প্রসূন ভট্টাচার্য: হাওড়া,
মানুষের কাছে পৌঁছানো, শ্রেণি ঐক্য গড়ে তোলা এবং জয় ছিনিয়ে আনার মতো সংগ্রাম গড়ে তোলার ডাক দিয়ে বুধবার সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের দশম সর্বভারতীয় সম্মেলনের শুরু হলো হাওড়ার শরৎ সদনে। সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে সভাপতির ভাষণে এ বিজয়রাঘবন বলেছেন, ‘অমৃত কোথায়? মোদী সরকারের হাত থেকে শুধুই বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের প্রলেতারিয়েতের জন্য কাজ নেই, মজুরি নেই, রয়েছে শুধু অত্যাচার। সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নকে দায়িত্ব নিয়ে এর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং জনবিরোধী মোদী সরকারকে হটানোর মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’ এই লক্ষ্যেই আগামী ৫ এপ্রিল দিল্লিতে সংসদ অভিযানে কিষান মজদুর সংঘর্ষ র্যা লিতে খেতমজুররা বিপুল সংখ্যায় অংশ নেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
এদিন সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি বিজয়রাঘবন এবং সাধারণ সম্পাদক বি ভেঙ্কট জমি, মজুরি এবং সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে খেতমজুরদের জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছেন। প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করে ভেঙ্কট বলেছেন, সংগ্রাম ছাড়া খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি করা যাবে না। আর এই মজুরির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি আরএসএস’র বিভাজনের কৌশল ভেস্তে দিয়ে শ্রমজীবীদের ঐক্যও গড়ে তোলা যাবে।
খেতমজুররাই যে সমাজের সবচেয়ে বেশি শোষিত এবং নিপীড়িত তা উল্লেখ করে ভেঙ্কট বলেছেন, শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিক বৈষম্যেরও শিকার তারাই। খেতমজুরদের সংখ্যাগরিষ্ঠই তো আদিবাসী এবং দলিত। আমরা যদি তাদের আন্দোলনে টেনে এনে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারি তাহলে হয় তাদের মধ্যে পরিচিতি সত্তার কথা বলে বিভাজন টেনে আনা হবে, নয়তো বিজেপি তাদের হিন্দুত্বের নামে সংগঠিত করে শ্রমজীবীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে।
তিনি বলেছেন, মোদী সরকার দেশে কর্পোরেট কৃষি ব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছে কারণ তাতে কর্পোরেট লুটের সুযোগ আরও বাড়বে। কর্পোরেট কৃষি মানে প্রথমত, জমি গরিবের হাত থেকে চলে যাবে এবং উন্নয়নের নামে আরও বেশি করে কর্পোরেট হাতে কুক্ষিগত হবে। দ্বিতীয়ত, কৃষিতে এমনিতেই কর্মদিবস কমছে, কর্পোরেট কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও কমবে, মজুরিও কমবে, সর্বনাশ হবে খেতমজুরদের। তৃতীয়ত, কৃষিতে মজুর হিসাবে কর্মরতদের ৬০ শতাংশ দলিত এবং মহিলা। কর্পোরেট কৃষি কখনোই তাদের সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে না। চতুর্থত, কর্পোরেট কৃষি খাদ্য সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে না। তারা মুনাফার লক্ষ্যে চাষ করবে, রপ্তানি বাণিজ্যে মুনাফা বাড়াবে, দেশের খাদ্য সুরক্ষা এবং গণবণ্টন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চিন্তাও তারা করবে না।
এভাবেই কর্পোরেট কৃষির বিপদ উল্লেখ করে খেতমজুরদের স্বাধীন আন্দোলন এবং কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য অংশের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেওয়া হয়েছে সম্মেলনের প্রস্তাবিত খসড়া রিপোর্টে। আগামী তিনদিন এই রিপোর্টের ওপরে আলোচনার পরে শনিবার সম্মেলনের শেষদিনে তা চূড়ান্ত হবে।
বিজয়রাঘবন সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বের ভাষণে দুনিয়া জুড়ে কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থানের পটভূমি উল্লেখ করে বলেছেন, ভারতেও এই ঘটনাই ঘটেছে। লকডাউনে মোদী ঘনিষ্ঠ আম্বানি আদানির মতো কয়েকজন ধনীর সম্পদ বেড়েছে, অন্যদিকে গরিব এবং ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। মহামারীকে ব্যবহার করা হয়েছে পুঁজিপতিদের নিষ্ঠুর শোষণে। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন খেতমজুররা। তাঁরা কাজ হারিয়েছেন, মজুরি হারিয়েছেন, যারা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা লকডাউনে দীর্ঘপথে হাঁটতে হাঁটতে প্রাণও হারিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এর মধ্যে একমাত্র বিকল্পের নজির দেখিয়েছে কেরালা। সেখানকার বামগণতান্ত্রিক সরকার খেতমজুরদের জন্য পেনশন, আবাস, গণবণ্টন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে।
এদিন সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেছেন, মোদী সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তাদের বুঝিয়ে বিরত করার প্রচেষ্টা শেষ, এবার প্রতিরোধের পালা। একমাত্র প্রতিরোধের লড়াই করেই শ্রমজীবীদের বাঁচা সম্ভব। খেতমজুরদের মধ্যে শ্রমিকদের অংশও রয়েছে যারা অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে কাজ করে রোজগারের চেষ্টা করছেন। শ্রমিক আন্দোলন এবং খেতমজুর আন্দোলনকে পারস্পরিক সহযোগিতায় সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী কনীনিকা ঘোষ বলেছেন, কৃষিতে খেতমজুরের কাজে জমির মালিকানায় এবং মজুরীতে মহিলারা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশ খেতমজুরদের আন্দোলনের পাশে মহিলা আন্দোলনও থাকবে।
ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য বলেছেন, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না, খেতমজুররা মজুরি পাচ্ছেন না, বেকার যুবরা কাজ পাচ্ছেন না। এই ধান্দার ধনতন্ত্রকে ধাক্কা দিতে সবাই মিলে আন্দোলন করতে হবে। এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ুখ বিশ্বাস বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন খেতমজুর পরিবারের ছাত্র। অনলাইন শিক্ষার নামে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ছিটকে যাচ্ছেন খেতমজুর পরিবারের ছেলেমেয়েরা। মোদী সরকার কেবল আম্বানি আদানিদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে এছাড়াও ভাষণ দেন বিকেএমইউ নেতা নির্মল।
সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সম্মেলন পরিচালনার জন্য এ বিজয়রাঘবন, অমিয় পাত্র, ওএস অম্বিকা, এ লাজার, ভি ভেঙ্কটেশানু, ভূপচন্দ চন্নো, ব্রিজলাল ভারতীকে নিয়ে গঠিত হয়েছে সভাপতিমণ্ডলী। অধিবেশনের শুরুতেই অমিয় পাত্র শোকপ্রস্তাব পেশ করেছেন এবং বিক্রম সিং শহীদ স্মরণে প্রস্তাব পেশ করেন।
ছবি’ অমিত কর
Comments :0