Flood Panskura

বুক সমান জলে ডুবে গ্রামের উৎসব

জেলা বিশেষ বিভাগ


 

রামশঙ্কর চক্রবর্তী
‘‘উনি যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন তখন বন্যা হলে বলতেন ম্যান মেড। সরকারের উপর দোষ দিতেন। ডিভিসি তখনও জল ছাড়তো। তাহলে এখন তো উনি মুখ্যমন্ত্রী। এই বন্যার জন্য দায়ী কে? কেন তিনি দায় নিচ্ছেন না? দায় তো তাঁরও।’’ বললেন শঙ্কর মাইতি। পাঁশকুড়ার মঙ্গলদাঁড়ির বাসিন্দা। একতলা ঘর ডুবে গিয়েছিল তাঁর। জল কমতে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তবে বাড়ির ভিতের ক্ষতি হয়েছে। বাড়ির ভিতর কাদা মাটি পরিষ্কার করতে করতে কথা চলল। ‘‘দেখুন দুই ভাই মিলে চার বিঘা জমিতে ধান চাষ করি। সবজি চাষের কিছু জমিও আছে। সব নষ্ট হয়েছে। ধান তো আর পাওয়া যাবে না। সবজি চাষের জমিতে আবার নতুন চারা বসাতে হবে। পুকুরের মাছও বেরিয়ে গেছে। আমাদের এই ক্ষতি কেউ বুঝবে না।’’ শঙ্কর মাইতি বললেন,‘‘এই যে ঘর ডুবে ছিল ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এই ঘরে থাকতেই ভয় হচ্ছে যদি ভেঙে পড়ে। ঘর সারাতে হবে। চাষের ক্ষতি হয়েছে। এত ক্ষতিপূরণ কে দেবে? সরকার তো বলে দিল ডিভিসির জলে বন্যা হয়েছে। এজন্য ডিভিসি দায়ী। জল তো প্রতিবছর ছাড়া হয়। নতুন তো নয়।’’
মঙ্গলদাঁড়ি বাজার ছাড়িয়ে গ্রামের একটি স্কুলের সামনে জটলা। মহিলা, বাচ্চা, বুড়ো সবাই আছে। মহিলাদের কয়েকজনের পরনে শাড়ি ভেজা। কথা হলো একজনের সঙ্গে। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছেন এখানে। ভেজা গায়ে কেন? ‘‘রাস্তা ডুবে আছে এখনও, জল পেরিয়ে তো আসতে হবে,’’ বললেন সবিতা মাইতি। অপেক্ষা ত্রাণের। পানীয় জলের। কয়েকজন গামলা, বালতি নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। যারা আসতে পারেনি তাঁদের ত্রাণও নিয়ে যাবে। টুকরো ছবি পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার।
পূর্ব মেদিনীপুরের কৃষির কেন্দ্র পাঁশকুড়া। সবজি, ধান, ফুল চাষের সম্ভার। ফসল হলে হাসি ফোটে কৃষকের। হাঁড়ি চড়ে সংসারে। কায়িক হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল মাঠেই নষ্ট হয়েছে। সরকারি রিপোর্টে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমির কৃষিজ ফসল নষ্ট হয়েছে। পাঁশকুড়ার বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বিভিন্ন দিকে। নির্দিষ্ট করে ক্ষতির পরিমাপ করা কঠিন। কৃষকদের কথায়, ‘‘এবারের চাষে ধান আর পাওয়া যাবে না। আগামী রোপণের আগে জমি নতুন করে প্রস্তুত করতে হবে। ফুলের ক্ষেত্রে চন্দ্রমল্লিকা সহ শীতকালীন ফুলের চারা রোপণের কাজ হয়ে গিয়েছিল। তা ক্ষতি হয়। আবার চারা বসালে শীতের মাঝামাঝি সময়ে ফুল পাওয়া যাবে। তেমনি শীতকালীন সবজিও সহজে জোগান পাওয়া দুষ্কর।’’
বন্যা ম্যান মেড। হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ তাহলে পূর্ব পরিকল্পিত ছিল? প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী রাস্তার পাশ থেকে বন্যা পরিদর্শন করেছিলেন পাঁশকুড়ায়। বানভাসিদের সঙ্গে তিনি কথা বলেননি। তবুও স্থানীয় তৃণমূল নেতারা ঝুঁকি নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছাকাছি যাতে বন্যার্তরা আসতে না পারে তার জন্য তৃণমূল কর্মীদের বেষ্টনী ছিল। তার পরেও দূর থেকে কিছু মানুষ যদি প্রশ্ন করে ফেলে? চিহ্নিত করে বেশ কয়েকজন বানভাসিকে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। 
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন বন্যা করানো হয়েছে। তাহলে কারা করল এমন পরিকল্পনা? বিশ্লেষণ চলছে।
১৯৭৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। ৪৬ বছর পর সীমাহীন দুর্ভোগ, ক্ষতির সম্মুখীন পাঁশকুড়া ব্লক ও পৌর এলাকার মানুষজন। জল নেমেছে এখন। জীবনযাত্রার ক্ষত সারিয়ে নতুন করে বহমান দিন গুজরান করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যেই একটা প্রশ্ন। বন্যা হলো কেন?
কয়েকদিন অতিবৃষ্টি এবং ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার ফলে গত ১৮  সেপ্টেম্বর থেকে পাঁশকুড়া ব্লক ও পৌরসভা এলাকায় ভয়াবহ বন্যা হয়। যা এখনো মানুষকে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। এদিকে ঘূর্ণাবর্তের কারণে দফায় দফায় বৃষ্টির ফলে জেলার পটাশপুর ১,২, এগরা ব্লকের পঞ্চায়েত গুলির কিছু অংশ এবং রামনগরের দুটি পঞ্চায়েতে ব্যাপক ধান, পান, শাক- সবজি, ফুল, মাছ, মাছের ভেড়ি, কাঁচা বাড়িঘর এবং সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্মের অভাবনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে জেলার মানুষকে। 
কাঁসাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছিল। কিন্তু একসঙ্গে গোবিন্দনগরের মানুর, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড, গড় পুরুষোত্তমপুর ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড এই চারটি বাঁধ ভাঙল কি করে? ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যে এ প্রশ্ন মানুষের মনে ছিল। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দুটি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা গেল। প্রথমত কাঁসাই নদী বহমান নয়। দৈর্ঘ্যে নদীর যা আয়তন সব অংশে সারাবছর জল থাকে না। প্রায় দশ ফুট করে দুই পাড়ে চর পড়ে গেছে। নদীর পাশ দিয়েই গ্রামীণ রাস্তা।  সেটাই নদীবাঁধ। অধিক বৃষ্টিতে নদীর জল রাস্তা সমান হয়। দ্বিতীয়ত দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় নদীবাঁধ সংস্কার ও নদীর ড্রেজিং না হওয়ার ফলে কোনও নজরদারি নেই।  বিভিন্ন এলাকায় বেআইনি নির্মাণ গড়ে উঠেছে নদী বাঁধ বরাবর। কোথাও প্রায় নদী চরেই। ফলে এরকম পরিস্থিতি হবে জেনেও সরকার, প্রশাসন ও পঞ্চায়েতের বন্যার পূর্বে প্রাক প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। দপ্তর ভিত্তিক আধিকারিকদের দায়িত্ব দিয়ে আগাম কাজের প্রস্তুতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়নি।
তেমনি সেচ-জল নিকাশের পথের ওপর এই কয়েক বছরে অবৈধ  বাড়ি নির্মাণ ও দোকানপাট করে জল নিষ্কাশনের খাল অবরুদ্ধ হওয়ার ফলে  জমা জল বের হতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছে। জেলায় ব্লক ও গ্রাম পঞ্চায়েতে এবং পৌরসভায় সর্বদলীয় বৈঠক করে ত্রাণ বণ্টনের সুব্যবস্থা না থাকার ফলে সীমাহীন দলবাজি এবং প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের উভয় সরকারকি তাদের দায় এড়াতে পারে? শুধু পূর্ব মেদিনীপুরে নয়,  ডিভিসি'র জল ছাড়ার ফলে হাওড়া, হুগলী, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার কিছু অংশ জলমগ্ন হয়েছে। 
জেলার পরিবেশবিদ, সেচ দফতরের প্রাক্তন আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা ধারণা নেওয়া গেল।
ঝাড়খণ্ডে কয়েক দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিপাতের ফলে ডিভিসি সংলগ্ন নিচু এলাকায় জল জমায় তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, সেটা প্রায় তিন ভাগের একভাগ। যার পরিণতিতে ডিভিসি থেকে জল ছাড়া হয়। যেমন তেনুঘাট ড্যাম থেকে জল ছাড়লে সেই জল আসে মাইথন ও পাঞ্চেত ড্যামে। মাইথন ও পাঞ্চেত ড্যাম ২ লক্ষ কিউসেক বেশি জল ছাড়া হয়। যা ডিভিসি হয়ে এলাকায় আসে। এখন যা পরিস্থিতি ৮০ হাজার কিউসেক জল ছাড়লে বন্যা হয়। কারণ দামোদর নিম্ন অববাহিকায় ছোট ছোট ড্যাম ও জোনিগুলোকে সংস্কার করা হয়নি কয়েকবছর। যা রাজ্য সরকারের আওতাধীন। মুণ্ডেশ্বরী, আমতা, দুর্গাপুর সংস্কার করলে  বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা সম্ভব। প্রসঙ্গত ডিভিসিতে সাতটি গেট বাঁধের প্রয়োজন। যেখানে রয়েছে চারটি। বাকি তিনটি বাঁধ না করতে পারলে প্রতিবছর এই জলের তীব্রতা বাড়বে। নিম্ন দামোদর অববাহিকা এলাকাগুলি অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি জলে ভাসবে। পরিকল্পনা করে বাংলাকে ডোবানো হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যে রাজ্যের সরকারও দায় এড়াতে পারে না। অন্যদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালে প্রতিবছর বন্যা হয়। ওই এলাকায় মানুষ প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে শিলাবতি, ঝুমি ও কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকা জলমগ্ন হয়। রূপনারায়ণ নদী দিয়ে জল বেরিয়ে গেলে কিছুটা সূরাহা হয়। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকাও শেষ কয়েকবছরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজ্যের সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা বলে দায় এড়াচ্ছে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শেষ বাজেট হয় ২০১৫ সালে। মোট বাজেটের ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। ৫০ শতাংশ রাজ্য ও ৫০ শতাংশ কেন্দ্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাহলে রাজ্যের অংশ দিয়ে কাজ এখনো শুরু হয়নি কেন ? প্রশ্ন উঠছে।
এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। সরকার উৎসবে ফিরতে বলেছে। কিন্তু যাদের হাতে কোনও কাজ নেই, টাকা-পয়সা নেই। যা দিয়ে তাঁদের পরিবারের ছেলে মেয়েদের জামা কাপড় তো দূরের কথা দু’বেলা খাওয়ার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এবার তাই অন্য উৎসব। বলছেন বিপর্যস্ত মানুষজনই। লক্ষ্মীকান্ত চক্রবর্তী, রাধাকান্ত চক্রবর্তী এদের দু’জনের বাড়ি গোবিন্দনগরের মানুরে। ভাঙা বাঁধের কাছেই বাড়ি এদের। বাড়ি ভেঙেছে। চাষের ফসল ক্ষতি হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে শুধুমাত্র ত্রাণের অপেক্ষায় এদের মতো সব হারানো পরিবারগুলি। মানুর গ্রামের ভিতরে গিয়ে দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে বেশ কয়েকটি বাড়ি ভেঙে গেছে। ধ্বংসের ক্ষতচিহ্ন পাঁশকুড়ার প্রান্তে প্রান্তে।

Comments :0

Login to leave a comment