Editorial

মৃত্যুটা নিছক সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে

সম্পাদকীয় বিভাগ

বড়বাজারের মেছুয়াপট্টির এক হোটেলের জতুগৃহে বিধ্বংসী আগুনের শিকার হয়ে চিরতরে নিভে গেল ১৪টি প্রাণ। না, কেউ হাতে ধরে আগুন লাগায়নি বা সরাসরি এসে কেউ গুলি করেও মারেনি। কিন্তু দমকল, পুলিশ, পৌর কর্পোরেশন, এমনকি স্থানীয় সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলরদের সীমাহীন গাফিলতির দায় অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ভোটে জেতা তোলা তোলার জন্য নয়, অসৎ উপায়ে কামানোর জন্য নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট পাবার জন্য যেমন পাড়া চষে বেড়ান তেমন না হলেও মাঝে মধ্যে যদি এলাকায় পদধূলি দেন, একটু খবরাখবর নেন, অবৈধ কাজকর্ম আটকানোর চেষ্টা করেন তাহলে বোধহয় এমনটা ঘটার সম্ভাবনা অনেক কমে যেত। খবর তারা রাখেন না তা নয়। সবটাই জানেন। আর জানেন বলেই অতি সহজে বুক ফুলিয়ে যাবতীয় অবৈধ কাজ করতে কারো অসুবিধা হয় না। সময় মতো এবং পরিমাণ মতো টাকা যথাস্থানে পৌঁছে গেলেই হলো। গোটা মহানগর জুড়ে এটাই এখন বাস্তব। দলদাস পুলিশের নিজস্ব কোনও দায় নেই। শাসক দাতাদের হুকুমই তাদের শিরোধার্য। তাই শুধু ঋতুরাজ হোটেল নয় কলকাতায় বিশেষ করে হাওড়া ব্রিজের দু’পাড়ে দুই শহরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যত হোটেল, রেস্তোরাঁ আছে তাদের কারো কাছেই দমকল, পৌরসভা ও পুলিশের যথাযথ ছাড়পত্র নেই। শাসক নেতা ও পুলিশকে টাকা দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে অবৈধ ব্যবসা চালায়। তাই প্রতিদিনই এমন একটি-দু’টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এবং মৃত্যুর মিছিল চললেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।
কে কৈফিয়ত দেবে চারতলা হোটেল ৬তলা হলো কি করে? তার ছাদেও অবৈধ নির্মাণ হয় কি করে! সমগ্র দোতলা ভেঙে ড্যান্সবার তৈরি অনুমোদন কে দিল? পাশে দুটো স্কুল থাকা সত্ত্বেও একতলায় পানশালা চলে কি করে? ২০২২ সালের পর দমকলের ছাড়পত্র নেই। অথচ পুলিশের ছাড়পত্র মিলে যাচ্ছে। সাজানো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে বটে তবে সেটা কাজ করে না। ঘটনার সময় রিজারর্ভারেও জল ছিল না, পাইপেও ছিল না। অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডারগুলিও কাজ করেনি। বাজেনি ফায়ার এলার্ম। আপৎকালীন বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও সেটা ছিল বন্ধ। তাছাড়া সিঁড়িটি বোঝাই ছিল নির্মাণ সামগ্রী আর আবর্জনায়। সিঁড়িটি খোলা পেলেও অনেকে প্রাণ বাঁচতে পারতেন।
পহেলগামে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুতে দেশ দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। কিন্তু হোটেলে পুড়ে ১৪ জন মরলেও দেশ দূরে থাক, কলকাতায়ও তেমন তাপ-উত্তাপ নেই। অথচ পহেলগামের ২৬ জনের মতো কলকাতার ১৪ জনও দেশের নাগরিক। পহেলগামে নাকি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী হিন্দু পর্যটক মেরেছে। তাই তার দায় চেপেছে গোটা কাশ্মীরিদের উপর। এমনকি সমস্ত ভারতীয় মুসলিমদের ওপর। তেমনি হামলাকারীরা যেহেতু পাক মদতপুষ্ট তাই বদলা নেবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝড় বইছে। প্রবল যুদ্ধোন্মাদনা চারদিকে।
কলকাতায় মৃতরা হিন্দু। কোনও মুসলিম তাদের মারেনি। তবে হোটেলের মালিক-পরিচালক সব হিন্দু। যাদের চূড়ান্ত গাফিলতিতে এই জতুগৃহ তাদের ধর্ম কেউ খুঁজছে না। যে কোনও মৃত্যু দুঃসহ বেদনার। যাদের নিকটজন মারা যায় এভাবে তারাই একমাত্র বোঝে সেই মর্মবেদনা। অন্যদের তা বোঝার কথা নয়। তাই স্বজন হারানোর বেদনার নিরিখে পহেলগাম, কলকাতা বা অন্য যে কোনও ঘটনায় মৃত্যু সমান। সব ক্ষেত্রেই আমাদের হৃদয় কাঁদুক সমানভাবে। সব ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠুক কেন এমন হলো? কে বা কারা এর জন্য দায়ী? খুঁজে বার করা হোক তাদের। কড়া সাজা হোক। তা না হলে মৃতরা ন্যায় বিচার পায় না। আর জি করের তরুণী ডাক্তার ন্যায় বিচার পায়নি। আমরিতে পুড়ে মরা ৯৩জন ১৪ বছর পরও বিচার পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা একের পর এক মৃত্যু মিছিল দেখেও সরকার শিক্ষা নেয় না। শাসক তোলা তুলতে যতটা উৎসাহী ততটাই নিরুৎসাহী বৈধ পথে সরকার পরিচালনায়।

Comments :0

Login to leave a comment