ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বুধবার প্রাণ হারালো দুই শিশু। দিনে প্রায় হাজার জন আক্রান্ত হয়েছেন মঙ্গলবার। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অবশ্য বলছেন, ‘‘ডেঙ্গুটা একটু একটু আছে। তবে ডাউন ট্রেন্ড আছে। যত শীত পড়বে, ঠান্ডা পড়বে ডেঙ্গু কমে যাবে।’’
হাওড়ার সালকিয়ার পিলখানার বাসিন্দা বছর নয়েকের জিশান এদিন ভোর ৩টে ১৩ মিনিট নাগাদ মুকুন্দপুর আমরি হাসপাতালে প্রাণ হারায়। এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছিল সে। স্থানীয় চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা করাতে বলায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শরীর খারাপ হতে থাকায় মঙ্গলবার রাতে বাইপাসের ধারে ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু সংক্রমণ মারাত্মক আকার নেয়। ওই শিশুর হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যায়। আইসিইউ’তে ভেন্টিলেশনে রেখেও বাঁচানো যায়নি। জিশানের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর প্রতিবেশীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। বারবার কর্পোরেশনে জানানো হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিয়মিত এলাকায় জঞ্জাল পরিষ্কার করা হয় না। এমনকি নিয়মিত এলাকার নালা নর্দমাও সাফ করা হয় না, দেওয়া হয় না মশা মারার ওষুধ। জিশানের কাকা মহম্মদ ইমতিয়াজ জানান, পিলখানা অঞ্চলে প্রতিদিন বহু মানুষ জ্বরে পড়ছেন। পরীক্ষা করলেই ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। প্রশাসনের কোনও ব্যক্তির দেখা পাওয়া যায় না। বিপদে পাশে যায় না কাউকে।
অন্যদিকে, বাগুইআটি-নারায়ণতলা এলাকার আট বছরের এক শিশুও প্রাণ হারিয়েছে ডেঙ্গুতে। ঋত্বিকা সাউ নামে ওই শিশু কয়েকদিন ধরেই জ্বরে ভুগছিল। সেইসঙ্গে ছিল আরও কিছু উপসর্গ। মঙ্গলবার তাকে বিসি রায় শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই মৃত্যু হয়েছে তার। মৃত্যু শংসাপত্রে ডেঙ্গুর উল্লেখ রয়েছে। মেয়র ফিরহাদ হাকিম দুঃখপ্রকাশ করে দায় সেরেছেন। আর এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘‘এখন কোভিড নেই, কমে গিয়েছে। ডেঙ্গুটা একটু একটু আছে, তবে ডাউন ট্রেন্ডে। যত শীত পড়বে, ঠান্ডা পড়বে ডেঙ্গু কমে যাবে। মিউনিসিপ্যাল, পঞ্চায়েত, এমএলএ যাঁরা আছেন, সতর্ক সজাগ থাকতে হবে। নানারকম জিন নিয়ে ডেঙ্গু বারবার আসছে। এখন মশা বাড়ার কারণ আছে— পুজো, বিসর্জন, দিওয়ালি, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদি। কাঠ, বাঁশ, জামাকাপড় অনেক জায়গায় পড়ে আছে, তোলা হয়নি। সুযোগ পেয়ে ওই জায়গাগুলোতে মশা ঘর বাঁধে। আবর্জনা যেন জমা না থাকে তা দেখতে হবে।’’
এদিকে, নমুনা পরীক্ষা বাড়তেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। মঙ্গলবার অর্থাৎ ৮ নভেম্বর রাতে স্বাস্থ্য দপ্তর যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যে দিনে প্রায় এক হাজারজন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। ওইদিন নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ছ’হাজারের বেশি। ঠিক তার আগের দিন অর্থাৎ সোমবার মাত্র ২ হাজার ৩৭১ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল। তাতে ৩৪৮ জন আক্রান্তের হিসাব পাওয়া যায়। এ বছর রাজ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। সরকার পরিসংখ্যান গোপন করলেও বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, অন্ততপক্ষে ৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। স্বাস্থ্য দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী কলকাতা, বিধাননগর, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। তবে এর বাইরেও অনেক জেলায় শহর ও গ্রামে ডেঙ্গু বেশ ভালোই থাবা বসিয়েছে।
এত মৃত্যুর পরও মুখ্যমন্ত্রীর এমন দায়সারা মন্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ বেড়েছে। চিকিৎসকদের একাংশের মতে, ঘরে আগুন লাগার পর জল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি জনস্বাস্থ্যের নিয়মের পরিপন্থী। শুরুতেই ডেঙ্গু মোকাবিলা নিয়ে আমরা বারবার সতর্ক করেছিলাম প্রশাসনকে। কিন্তু সে সময়ে মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন উৎসবের নানা কর্মসূচিতে। ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখনও কিন্তু পরিস্থিতি উন্নতির কোনও চেষ্টা নেই সরকারের তরফে। শুধু বৈঠকের পর বৈঠক আর প্রচার সেরে ক্ষান্ত দিচ্ছেন নেতা-মন্ত্রীরা।
ডেঙ্গু চরম আকার নেওয়ার পর জনবিক্ষোভ আঁচ করে এদিন প্রচার মাধ্যমের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে চেতলা ও ভবানীপুর এলাকা পরিদর্শনে যান কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। যথারীতি ওই এলাকায় খালি জমিতে জল জমে থাকার দৃশ্য তাঁর নজরে আসে। তাহলে কর্পোরেশন এতদিন কি কাজ করল? আর ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে মেয়র এতদিন ধরে কি কি বললেন ডেঙ্গু মোকাবিলা নিয়ে – তার কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।
Comments :0