দিনরাত এক করে কর্মশ্রী প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ জারি করেছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর!
কেন এই দ্রুততা?
সপ্তাহ খানেক আগে কর্মশ্রী প্রকল্প নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। সেই পর্যালোচনা বৈঠকের পর সরকার জানতে পারে, এখনও পর্যন্ত গড়ে ৩৬ দিনের কাজ দেওয়া গেছে। বছরের ছয় মাস পার হয়ে গেছে। বাকি ছয় মাসের মধ্যে পার করতে হবে গত আর্থিক বছরের ( ২০২৪-২৫) ৫৮ দিনের লক্ষ্যমাত্রা। তাই কীভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় তারজন্য রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর থেকে নির্দেশ গেছে জেলা প্রশাসনের কাছে। যেভাবেই হোক দিনরাত এক করে নির্বিচারে কর্মশ্রী প্রকল্পে রাজ্যে যে বিপুল পরিমাণ জবকার্ড গ্রাহকদের কাজ দেওয়া হয়েছে তা সরকারের পোর্টালে নথিভুক্ত করতে হবে। তাই রাজ্যজুড়ে ব্লক প্রশাসন কর্মশ্রী পোর্টালে জবকার্ড নাম্বার সহ গ্রামবাসীদের নাম নথিভুক্ত করে যাচ্ছে। যে কোনও মূল্যে বাড়াতে কর্মশ্রী প্রকল্পে এরাজ্যের গ্রামীণ শ্রমজীবী জনতা বিপুল পরিমাণ কাজ পাওয়ার তথ্যকে।
কীভাবে নথিভুক্ত করা হচ্ছে?
রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চায়েত স্তরে সরকারি যে কোনও প্রকল্পের টাকা খরচ হয়েছে এমন কাজ প্রথমে খুঁজে নেওয়া হচ্ছে। তারপর সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে জবকার্ড গ্রাহকদের নাম। পঞ্চায়েত দপ্তরের এক কর্তার কথায়, ‘‘জবকার্ড নাম্বার সহ যাঁর নাম কর্মশ্রী পোর্টালে নথিভুক্ত করা হচ্ছে তিনি নিজেই জানতে পারছেন না। হয়তো খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে, রাজ্যে কাজ না পেয়ে সেই মানুষটি এখন ভিনরাজ্যে ঘরছাড়া শ্রমিক হয়ে চলে গেছেন।’’
রাজ্যে কাজের সমস্যা কতটা তীব্র তাঁর প্রমাণ সন্দেশখালি ব্লকের খুলনা গ্রাম পঞ্চায়েতের যুবক অলোক সরদার। তিন মাস আগে কেরালা থেকে সন্দেশখালির গ্রামে ফিরেছিলেন। কিন্তু গ্রামে ফেরার পর একটাও কাজ জোটাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে গত শনিবার গ্রাম ছেড়ে হাওড়া স্টেশন থেকে অন্ত্যোদয় এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরার টিকিট কেটে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের এর্নাকুলামে। কিন্তু জেনারেল কামরার টিকিট কেটে যেতে পারেননি। কেন? অলোক সরদার জানান, ‘‘জেনারেল কামরায় আগে থেকেই এরাজ্যের শ্রমিকদের এত ভিড় হয়ে যায় তারজন্য রেল পুলিশ কামরাতেই উঠতে দেয়নি। ফলে ট্রেনের টিকিট কাটার টাকা নষ্ট হয়ে গেছে। আবার বাড়ি ফিরে এসেছি।’’ কিন্তু বাড়িতেও থাকার কোনও সুযোগ নেই। কারণ, গ্রামে কোনও কাজ নেই। তাই আবার টিকিট কাটার টাকার সংস্থান করে বাড়ি ছাড়বেন বলে মনস্থির করেছেন অলোক সরদার সহ সন্দেশখালির খুলনা গ্রামের প্রায় জনা পঁচিশেক যুবক।
আর সেই রাজ্যের কর্মশ্রী পোর্টাল কী দাবি করছে?
বছরে ৫০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা দিয়ে কর্মশ্রী পোর্টাল দাবি করছে, এরাজ্যে এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকার কর্মশ্রী প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে সরকারের ৫২টি দপ্তরকে যুক্ত করে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত করেছে। যে কাজের মাধ্যমে চলতি বছরে ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা জব কার্ড গ্রাহকদের মজুরি হিসাবে দেওয়া হয়েছে। এমন ভুয়ো তথ্য ফি দিন পোর্টালে পঞ্চায়েত দপ্তরের ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে নথিভুক্ত করানো হচ্ছে। ব্লক প্রশাসনে কর্মরত এক সরকারি আধিকারিকের কথায়,‘‘ ধরুন কোনও গ্রাম পঞ্চায়েতে সরকারের মৃতদেহ সৎকারের জন্য ‘সমব্যথী’ প্রকল্পে ২ হাজার টাকা কেউ পেয়েছেন। এখন কর্মশ্রী প্রকল্পে সেই নামও টাকার অঙ্ক দিয়ে কাজ পাওয়ার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।’’ সম্প্রতি বাংলার বাড়ি প্রকল্পে দুই কিস্তিতে ১লক্ষ ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন গ্রামের মানুষ। কর্মশ্রী প্রকল্পে সেই টাকাও কাজ পাওয়ার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তরের যে পরিকল্পনা বাজেটে ঠিকাদারের অধীনে যে কাজ হয়েছে তাকেও যুক্ত করে নেওয়া হচ্ছে কর্মশ্রী প্রকল্পে। পূর্ত দপ্তর, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর, সেচ দপ্তরের মাধ্যমে ঠিকদারদের দিয়ে কাজ করানোর পর সেই তথ্য জোগাড় করে নিচ্ছে পঞ্চায়েত দপ্তর। তারপর সেই কাজ ও বরাদ্দ টাকার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের জবকার্ড গ্রাহকদের নাম কর্মশ্রী পোর্টালে নথিভুক্ত করা হচ্ছে। আগে ১০০ দিনের কাজে কাজ হওয়ার পর জবকার্ড গ্রাহকদের মোবাইলে এসএমএস মারফত তথ্য চলে আসতো। এখানে তা হচ্ছে না। ফলে গ্রামের গরিব মানুষের জানার কোনও উপায় নেই, তাঁর জবকার্ড নাম্বার ব্যবহার করে সরকার কীভাবে প্রতারিত করছে। একইভাবে ঠিকাদার সংস্থার পক্ষেও জানা সম্ভব হচ্ছে না তথ্যেই এই কারচুপিকে।
কাজ নিয়ে রাজ্যের গরিব মানুষের সঙ্গে এহেন নির্লজ্জ প্রতারণাকে এখন স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে রাজ্যের প্রশাসনের শীর্ষ মহল। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা মুখ্যসচিবও এখন প্রশাসনিক সভাতে বলেন,‘‘ কর্মশ্রীতে সব দপ্তরকে নিয়ে একসাথে কাজ করা দরকার। গত বছর(২০২৪-২৫) আমরা ৭৫ লক্ষ জবকার্ডকে কর্মশ্রীতে নথিভুক্ত করেছিলাম। তাতে ৫৮ দিন কাজ হয়েছিল। ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।’’ মুখ্যসচিবের এহেন ভুয়ো তথ্যের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলছেন,‘‘ ১০০ দিনের কাজে তো ২৮-৩০ দিনের বেশি কাজই হতো না। আমরা তো গতবার ৫৮ দিন কাজ দিয়েছি। এবার সেটা ৬৫ থেকে ৭৫ দিন করতে হবে। সব পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে আসুক। তাদের আমরা কাজ দেব।’’
রাজ্য প্রশাসনের অন্দরেই এখন কর্মশ্রী প্রকল্পের এহেন তথ্যের কারচুপি থেকে মিথ্যাচার নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আধিকারিকরাই বলছেন, ‘‘রাজ্যে এখন আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান নাম দিয়ে একটা প্রকল্প চালু করা হয়েছে। তাতে সরকার প্রতি বুথের জন্য ৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু কর্মশ্রী প্রকল্পের জন্য রাজ্যের বরাদ্দ কত?’’ বিনা বরাদ্দে লক্ষ, লক্ষ গরিব মানুষকে কাজ দেওয়ার ভুয়ো তথ্য দিয়ে এভাবেই চলছে প্রতারণা।
গত এক মাস ধরে রাজ্যের প্রায় ১৩০ টির ব্লকে ১০০ দিনের কাজের জন্য ‘৪ক’ ফরম ফিলাপ করে জমা দিয়ে এসেছেন গরিব মানুষ। ১৫ দিন অপেক্ষার পর ফের তাঁরা কাজ নয়তো ভাতার দাবি নিয়ে জড়ো হবেন ব্লক অফিসে। সারা ভারত খেতমজুর সমিতির রাজ্য সম্পাদক নিরাপদ সরদার জানান, ‘‘এলাকায় কাজ নেই এটা মানুষ বুঝে গেছেন। কেউ আর এলাকায় কাজের ভরসা করছে না। এতদিন বর্ষার জন্য মাঠে চাষের কাজ ছিল। এবার তা শেষ। মানুষ আবার বেরিয়ে পড়েছেন ভিনরাজ্যের পথে।’’
Karmashree
কাজের আকালে টিকিট কেটেও ট্রেনে চড়তে পারছে না পরিযায়ী শ্রমিক!

×
Comments :0