যে নির্বানের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটে এবং সরকার গঠন হয় সেই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে হতে হয় প্রশ্নাতীত স্বচ্ছ এবং যে কোনও ধরণের পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে। এটাই যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অপরিবর্তনীয় শর্ত। স্বাভাবিকভাবেই যে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এই নির্বাচন পরিচালনা করে তার কর্ণধারদের হতে হবে দলীয় রাজনীতির ছোঁয়া বর্জিত গণতন্ত্রের নিখাঁদ পুজারি। সংবিধানের প্রতি তাদের থাকতে হবে দ্ব্যর্থহীন আনুগত্য ও শ্রদ্ধা। দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে সর্বোচ্চ সততা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে তাদের পরিচালনা করতে হয় নির্বাচন। তাদের চোখে শাসক দল কি বিরোধীদল কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। বিধি লঙ্ঘন করলে একজন সাধারণ বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিতে হবে, একই ব্যবস্থা নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। প্রধানমন্ত্রী হলে সাত খুন মাপ হবার কোনও বিধান গণতন্ত্রে নেই। বরং আদর্শ নির্বাচন বিধি অনুসরণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার দায় বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর। কারণ তিনিই দেশের নেতা। শাসকের চাপের কাছে মাথা নত না করে, সংবিধানের কাছে মাথা নত করে, মেরুদণ্ড সোজা করে দৃঢ়তার সঙ্গে যদি নির্বাচন কমিশন কাজ করার সাহস দেখাতে পারে তবেই বলা যাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংবিধানের নির্দেশ মেনে চলছে, শাসকের অনুগত হয়ে চলছে না।
এই প্রসঙ্গগুলি নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ছে এই কারণে যে নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে দেশের মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। কমিশনের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটাও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অবাধে, শান্তিপূর্ণভাবে ও নির্ভয়ে আপন ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। বাস্তবে সেটা ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলেই এটা জোর দিয়ে বলা যায় না এদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী আছে। শুধু ভোট গ্রহণ বা ভোট গণনা পর্বেই নয়, নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্বেই চলছে অস্বচ্ছতা, কারচুপি, পক্ষপাতিত্ব। ক্ষমতা দখলের লোভ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রধানত শাসক দলকে এতটাই বেপরোয়া ও স্বৈরাচারী করে তুলছে যে তারা সংবিধানকে উপেক্ষা করে খোদ নির্বাচন কমিশনকেই কুক্ষিগত করে নিজের স্বার্থে চালানোর চেষ্টা করে। তার জন্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সেইসব ব্যক্তিদেরই নিয়োগের ব্যবস্থা করে যারা শাসক দলের অনুগত এবং একরকম জো হুজুর।
শাসক দলের এহেন প্রয়াস নিকৃষ্ট স্তরে পৌঁছেছে মোদী জমানায়। তিনি কোনোরকম রাখঢাক না রেখে একেবারে সরাসরি নিজের পছন্দের বিশ্বস্ত লোকদের কমিশনার বানাচ্ছেন। তারজন্য যেখানে যে ছক করার দরকার সেটাই করছেন। নির্বাচন কমিশন কোনও সরকারি বা সরকার পরিচালিত সংস্থা নয়। এটা একটা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক মর্যাদা বজায় রেখে যদি নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করতে হয় তাহলে তার কমিশনারদের বাচতে হবে একেবারে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে। কোনোরকম দলীয় রাজনীতির সংস্রব বা ছিটেফোঁটা আনুগত্য আছে, তা সে প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে, এমন ব্যক্তি কমিশনার হবার যোগ্য নয়। যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন সরকারের পক্ষে অসম্ভব। সরকার যে রাজনৈতিক দল চালায় তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বাস্তবাগিত করে সরকার। তাই কমিশনার নিয়োগের জন্য যে কমিটি সেখানে কোনও পক্ষেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাখা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং প্রধান বিচারপতির কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছিল কমিশনার নিয়োগের জন্য। মোদী সরকার সেই নির্দেশ ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছেঁটে সেখানে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত এক মন্ত্রীকে যুক্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন পাশ করেছে। আর সেই আইন মেনে মোদী-শাহ-র অতি ঠনিষ্ঠ বিশ্বস্তদের নিয়োগ করেছে কমিশনার পদে। আগামী দিনে নির্বাচন কমিশনকে কার্যত বিজেপি-র শাখায় পরিণত করে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের বন্দোবস্ত করেছে। অর্থাৎ জনতার রায়ে ক্ষমতায় টিঁকে থাকা সম্ভব না হলেও কমিশনকে ব্যবহার করে অস্বচ্ছ ও অনৈতিক পথে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে। তারজন্য যদি গণতন্ত্রের সলিল সমাধি হয় তাতেও তাদের আপত্তি নেই।
EC
নির্বাচন কমিশন কি বিজেপি-র শাখা

×
Comments :0