EDITORIAL NABANNA MOVEMENT

দুয়ারে বিক্ষোভ, নবান্নের!

রাজ্য

প্রাপ্য পরিষেবা রাজ্যবাসীর দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু তিনি কি টের পাচ্ছেন, গণবিক্ষোভ ক্রমশ নবান্নের তাঁরই দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে? শুক্র ও শনিবার নবান্নের সামনে প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতার দাবিতে সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভ যথেষ্ট লক্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু বিক্ষোভের মাত্রার জন্যই নয়, সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে, আদালতের নির্দেশ নিয়ে যেভাবে তাঁরা নবান্নের দ্বারে পৌঁছেছেন তা অর্থবহ। মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারকে তাঁরা মাথা নিচু করাতে পেরেছেন। শেষপর্যন্ত প্রাপ্য আদায় হবে কিনা তা অবশ্য এই লড়াইয়ের পরবর্তী ধাপগুলির ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে সব বিরোধী কণ্ঠস্বরকে থামাতে চেয়েছিলেন, যেভাবে মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাতে চেয়েছিলেন, তা ক্রমশই বানচাল হয়ে যাচ্ছে। 
মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারের দুটি কুযুক্তির অসারত্ব এখন স্পষ্ট। প্রথমত, মহার্ঘ ভাতা যে কর্মচারীদের ন্যায্য প্রাপ্য এবং এটা যে তাঁদের অধিকার তা মুখ্যমন্ত্রী অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ডিএ দিতে আমি বাধ্য নই। কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের হক ছেড়ে দেননি, তাঁরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ছাড়াও আদালতে গিয়েছিলেন অধিকার আদায়ে। আদালত সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, ডিএ কর্মচারীর অধিকার, এটা বেতনেরই অংশ। বাস্তবিকই মহার্ঘ ভাতার উৎপত্তি এই ধারণা থেকেই। সরকার যদি মূল্যবৃদ্ধি থামাতে না পারে, কর্মচারীদের প্রকৃত আয় কমে যেতে বাধ্য, অথচ ব্যয় বাড়তেই থাকে। তাই সমতা আনতে মহার্ঘ ভাতা দিতে সরকার বাধ্য। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের, মন্ত্রীদের এবং বিধায়কদের বেতন বহুগুণ বাড়িয়েছেন। কিন্তু রাজ্যবাসী এখন সেটারও হিসাব করার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ তাঁরা শাসকদলের নেতা মন্ত্রীদের ঘর থেকে চুরি দুর্নীতির কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উদ্ধার হতে দেখেছেন। যারা দুর্নীতির টাকায় ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তাঁরা কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতার গুরুত্ব বুঝবেন, এমন দুরাশা কর্মচারীরাও করেন না। তাই প্রাপ্য বুঝে নিতে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন। 
মুখ্যমন্ত্রীর এতেও আপত্তি। তিনি সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টে বড় বড় আইনজীবী লাগিয়ে মামলা লড়েছেন প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা প্রদান আটকাতে। পারেননি। তারপরে ৪০ শতাংশ বকেয়া মহার্ঘ ভাতার বদলে মাত্র ৪ শতাংশ ছুঁড়ে দিয়েছেন ভিক্ষার ছলে। এরপরেও কর্মচারীরা বিক্ষোভ দেখাতে পারবেন না? কেন্দ্রের মোদী সরকার যেভাবে যাবতীয় গণআন্দোলন ঠেকাতে পুলিশিরাজ কায়েম করছে সেই পথেই হাঁটছেন মমতা ব্যানার্জিও। কিন্তু নবান্নের সামনে বিক্ষোভ ঠেকাতেও মুখ্যমন্ত্রীর ফতোয়া কলকাতা হাইকোর্ট উড়িয়ে দিয়েছে। রাজ্য সরকারের আইনজীবীদের যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, ‘কর্মচারীদের ৪ শতাংশ ডিএ দেওয়ার কথা ঘোষণা হয়েছে। এখনও বকেয়া রয়েছে ৩৬ শতাংশ। তাহলে কর্মচারীরা বিক্ষোভ আন্দোলনের সঠিক পথেই রয়েছেন।’ 
এভাবেই মহার্ঘ ভাতার অধিকারের প্রশ্ন থেকে বিক্ষোভ আন্দোলনের অধিকারের প্রশ্নের রাজ্য সরকারের সংগ্রামী কর্মচারীদের সামনে বারবার পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে তৃণমূল সরকার। সংগ্রামী জনগণের সামনে যতবার পিছু হটতে হচ্ছে, ততোই মরিয়া ও হিংস্র হয়ে উঠছে এই শাসকদল। আজ পর্যন্ত তারা চাকরি লুট হয়ে যাওয়া চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার দিতে পারেনি, কোনও লুট দুর্নীতিরই ন্যায়বিচার করেনি, বরং প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে তৎপর হয়েছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে বিদ্বেষ ছড়ানো শক্তিগুলিকে দমন করতে দায়বদ্ধ সরকার। কিন্তু এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তির কার্যকলাপ দমনে তৃণমূলের সরকারের কোনও তৎপরতা দেখা যায়নি, উলটে ন্যায়বিচার চাওয়া প্রতিবাদীদের দমন করতে সর্বোচ্চ তৎপরতা দেখিয়ে চলেছে। এই কারণেই ইনসাফ যাত্রাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এখনও ব্রিগেডে যুবদের সমাবেশ রোখার চেষ্টা চালানো হচ্ছে তলে তলে। শেকসপিয়রের ম্যাকবেথ নিজের অন্তিম লগ্ন টের পেয়েছিলেন, পাহাড়ের দিকে জঙ্গলকে এগিয়ে আসতে দেখে। নবান্নের চোদ্দ তলা থেকে মুখ্যমন্ত্রী কি গণআন্দোলনের সেভাবেই ধেয়ে আসাকে দেখতে পাচ্ছেন না?
 

Comments :0

Login to leave a comment