Jatha Padayatra series

ভুটানে ইটভাটায় ভাটা, ধাক্কা লুৎফরদের ঘরে

রাজ্য

ভুটানে ইটভাটায় ভাটা পড়েছে। তার ধাক্কা শীতলকুচিতে।  
গোলেনাওহাটির কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা আর অসংগঠিতরা শ্রমিকরা যখন পদযাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শিতলকুচি বাজারের পশ্চিম দিক থেকে তখন মিছিলের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিজানুর, লুৎফর, সিরাজউদ্দিনরা। প্রায় ৬-৭ জনের দল। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না, ওঁরা মিছিল দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে। কথা শুরু করতেই লুৎফর বলে উঠলো, ‘‘এবারে পুজোর আগে সর্দার দাদন দিতে আসেনি। চেয়ে চিনতে কিছুটা দাদন নিয়েছি। অথচ আগের পুজোর সময় সর্দার মোটরবাইক নিয়ে বাড়ি এসে হাতে গুঁজে দাদন দিয়ে যেত। এবারে কয়লার দাম নাকি বেড়েছে। ইটভাটায় শ্রমিকের চাহিদা নেই। কাজ মিলতে পারে বড়জোর দু’মাস।’’ 
সিরাজের জিজ্ঞাসা, দু’মাসের ইনকাম দিয়ে বারো মাস কি করে চলবে?
ওদের দলটার মধ্যে মিজানুরের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। মুখ খুললেন তিনি। বললেন, ‘‘নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মেরেছি। কেন যে মরতে সেবার তৃণমূলকে ভোট দিয়ে এই পার্টিটাকে হারালাম! এখন তো আর ভোট দিতেই পারি না।’’
নগর সিঙ্গিমারির গায়ে কাঁটাতার। ওপারে বাংলাদেশের গ্রাম সিঙ্গিজানি। ওপারে জিরো পয়েন্ট থেকে বেড়া পর্যন্ত রয়েছে কয়েক হাজার একর জমি। এসব জমিতে চাষ করতে বিএসএফ’র মরজির ওপর ভরসা করতে হয়। লকডাউনের সময় শিতলকুচিতে বেড়ার ওপারের ফসল কাটতে দেয়নি। গ্রামের মহিলারা বিএসএফ’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও লড়াই থামেনি। অবশেষে জেলা শাসকের মধ্যস্থতায় ফসল ঘরে তুলেছে সীমান্তের কৃষক।
সীমান্তের বাসিন্দা অরবিন্দ বর্মণের গলায় যেন কৃষকসভার নেতার কথারই প্রতিফলন, ‘‘হামারলার কথা কাহোয় ভাবে না। বেড়ার ওপারের নিজের জমিত চাষ করা যায় না। বিএসএফের দপদপির জন্যি। পঞ্চায়েতের ঘর তো লুটি খাইতে ব্যস্ত। হামার কথা পঞ্চায়েত, মন্ত্রী কাহোয় ভাবে না।’’
সত্তর পেরোনো সুন্দরী বালা বর্মণ মিছিল দেখে দু’হাত তুলে কপালে লাগিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘‘বাড়ুক,বা ড়ুক ইমরালা বাড়ুক। দেশত শান্তি ফিরুক।’’
মিছিলের একেবারে সামনের দিকে লাল ঝান্ডা উঁচিয়ে স্লোগানে গলা মেলানো মানুষটা ছোটশালবাড়ির গোপাল বর্মণ। কৃষকসভা করার অপরাধে ৫ ভাইয়ের ৪ বিঘা চাষের জমি কেড়ে নিয়েছেন তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য ছকমল মিয়া। এখন সেই জমি চাষ করেন অন্যেরা। দাপুটে পঞ্চায়েত সদস্য গোপালকে ডেকে বলেছে, ‘‘তৃণমূলের কাছে স্যারেন্ডার কর। জমি ফেরত পাবি।’’ হাঁটতে হাঁটতে নিজেই বলেছেন, ‘‘ওদের কাছে স্যারেন্ডার করলে হয়তো জমি ফেরত পেতাম। কিন্তু ইজ্জত বিক্রি হতো। জমি হারিয়েও ১১ বছর ধরে লাল ঝান্ডা হাতে মিছিলে হাঁটি।’’ 
পদযাত্রার আরেক মুখ মেজর রায়। নগর লালবাজারের বাসিন্দা। ১০ কাঠা চাষের জমির দখল নিয়েছেন তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যা বাবলি বর্মণ। জমির কাগজ মেজর রায়ের ট্রাঙ্কে। অথচ সেই জমি ভোগ করছেন পঞ্চায়েত সদস্যের কাছের লোক দুলাল সরকার। সব হারিয়েও মেজর রায় পদযাত্রায় হাঁটছেন মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে। 
মধ্য শিতলকুচির নূর ইসলামের ১৫ শতক চাষের জমি ৩ বছর আগে দখল নিয়েছে তৃণমূল। জমি ফেরত পেতে খাপ পঞ্চায়েতে যেতে হয়েছিল নূর ইসলামকে। জমি ফেরত হয়নি। উলটে ২০ হাজার টাকা জমা আছে স্থানীয় তৃণমূল নেতার কাছে। জমি, নগদ টাকার আশা ছেড়েছেন নূর ইসলাম। ছাড়েননি লালঝান্ডা।
৫ বছর আগের লুটের পঞ্চায়েতে যারা মনোনয়ন জমা দিয়েও তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা এখন কোথায়? কৃষক নেতা হরিশ বর্মণ জানালেন, ‘‘এই পদযাত্রায় যাঁরা হাঁটছেন হয় তাঁরা কিংবা তাঁদের স্ত্রী, মেয়ে গত পঞ্চায়েতে লড়তে চেয়েও পারেনি। এবারে জেদ নিয়েই পথে নেমেছেন মানুষের পঞ্চায়েত গড়তে। পদযাত্রার একেবারে শেষের দিকে থাকা মনিরাম বর্মণের স্ত্রী জয়ন্তী বর্মণ গত পঞ্চায়েত ভোটে লড়তে চেয়েও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবারে পদযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে জানালেন, ‘দল চাইলে প্রয়োজনে ফের লড়বে আমার পরিবার।’
পদযাত্রার বিরতি ঘোষণা করলেন কৃষকসভার নেতা অনন্ত রায়। কৃষকসভার জেলা সভাপতি বিপিন শীল সূচনা করেছিলেন পদযাত্রার। দুজনেই হাঁটলেন। মাইকে ঘোষণা চলছে, রাত পোহালে ফের অন্য বুথে অন্য গ্রামে অন্য মুখেরা লালঝান্ডা হাতে হাঁটবেন পদযাত্রায়।
 

Comments :0

Login to leave a comment