প্রসূন ভট্টাচার্য: দমদম
সিনেমার শেষ দৃশ্যের ভিলেনের মতো অবস্থা দমদমের তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়ের। দমদমের মানুষের ক্ষোভ থেকে নিষ্কৃতি পেতে যে পথে ছুটছেন, সেই পথই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
পানিহাটিতে আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় অবরোধে পড়েছিলেন সৌগত রায়। নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার পথে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর গাড়িই আটকে যায় পানীয় জলের দাবিতে স্থানীয়দের অবরোধে। অবরোধকারীরা প্রায় সবাই মহিলা, তাঁদের প্রশ্ন, এই গরমে পানীয় জলের সমস্যা কবে মিটবে? সেদিনকার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোনে কেএমডিও’র কর্তাদের সঙ্গে ফোন করে ক্ষোভ ধামাচাপা দিলেও, কোথাও জল, কোথাও রাস্তা, কোথাও নিকাশি, কোথাও আবর্জনার স্তূপ নিয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়তেই হচ্ছে পনেরো বছরের দমদমের সাংসদকে।
বিরক্ত সৌগত রায় নিষ্কৃতি পেতে সাংবাদিকদের বলেই ফেলেছেন, ‘এলাকার জলকল সাংসদের কাজ নয়, সংসদে রোজ রোজ এলাকার জল নিয়ে বলা যায় না। এগুলো রূপায়ণের জন্য রাজ্য সরকার ও পৌরসভা আছে।’ কিন্তু সংসদ এবং সাংসদের কাজ নিয়ে তর্কে না গিয়ে এলাকায় এলাকায় সিপিআই(এম) কর্মীরা বলতে শুরু করেছেন, রাজ্য সরকারে কে আছে? কারা চালাচ্ছে এই লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি পৌরসভা? সর্বত্র তৃণমূলের দখলদারির সুবিধা নিয়েছে যারা, কাজের দায় কাদের ঘাড়ে ঠেলবে তারা?
সাংসদের বড় দায়দায়িত্বের কথা বলেও সৌগত রায় পার পাচ্ছেন না। দমদমের সিপিআই(এম) প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘দমদম তো শিল্পাঞ্চল। উনি শুধু সাংসদ নয়, কেন্দ্রের মন্ত্রীও হয়েছিলেন, কিন্তু কটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প এনেছেন? কটা নতুন শিল্প এনেছেন দমদমে? উলটে তৃণমূল রাজ্যে সরকারে আসার পরে, ডাকব্যাক, প্রিয়া বিস্কুট, ইন্ডিয়া ফয়েলস বন্ধ হয়েছে। জেশপের জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’
২০০৯ সাল থেকে প্রতি লোকসভা নির্বাচনে সৌগত রায় যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কিছুই হয়নি। ৭৭বছর বয়সে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নেমে তিনি বলছেন, ‘কেন্দ্রে বিরোধীদের সরকার থাকলে কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে আসা এত সহজ নয়। তার মধ্যেও আমি অনেক কিছু করেছি।’ সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘ইউপিএ সরকার থাকাকালীন আমরা চাপ দিয়ে দমদম সহ রাজ্যে মানুষের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প এনেছিলাম। পরিবেশ এবং চটকল বাঁচাতে জুট প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করিয়েছিলাম। কলকাতার গা লাগোয়া দমদমের মতো শহরাঞ্চলের উন্নতির জন্য যে ধরনের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা রূপায়ণ দরকার তা নিয়ে তৃণমূলের উদ্যোগ দেখেছেন কেউ? এখন শিল্প বিপন্ন, শিক্ষা বিপন্ন, চারিদিকে শুধু মদের দোকান খুলছে।’
যুক্তির ব্যূহে ঘেরা পড়তেই সৌগত রায় বলতে শুরু করেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী, তারা তো বাইরে থেকে এখানে এসেছেন। অন্য জায়গায় হেরে দমদম কেন্দ্রে এসেছেন।’ সুজন চক্রবর্তীর পালটা উত্তর দিচ্ছেন, ‘আমি ভারতের মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, এভাবে নিজেকে বাইরের ভাবি না। তবে সৌগতবাবু ভুলে গেছেন উনি হারতে হারতে আলিপুর থেকে বনগাঁ হয়ে দমদমে এসেছিলেন।’
আদতে অবশ্য বাইরে দূরের পরিচিতি নয়, দলীয় পরিচিতি নিয়ে দমদমের মানুষ প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূল-বিজেপি’র উদ্দেশ্যে। কারণ দমদম আর বারাকপুর দুটো পাশাপাশি লোকসভা কেন্দ্রেই বিজেপি লড়াই করছে তৃণমূলের দুই প্রাক্তনীকে সামনে রেখে। বারাকপুরের ভোট হয়ে গেছে, লড়েছেন অর্জুন সিং, আর দমদমে লড়ছেন শীলভদ্র দত্ত। এই শীলভদ্র বারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক ছিলেন কয়েকবছর আগেও। এখন তিনিই বিজেপি’র প্রার্থী হয়ে তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙছেন। শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি’তে যোগদানের পর থেকে বিজেপি নারদ ঘুষকাণ্ড নিয়ে হইচই করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভোটের মুখে শীলভদ্র দত্ত ক্যামেরার সামনে সৌগত রায়ের ঘুষ নিয়ে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলার বহুলপ্রচারিত দৃশ্যের উল্লেখ করছেন। সেই সঙ্গে একথাও বলছেন, ‘বন্ধ জেশপের যন্ত্রাংশ বিক্রি করে কাটমানি আদায় করছে কারা?’
দুর্নীতিতে তৃণমূল আর বিজেপি’র কার কাদা কার গায়ে লাগছে, তা খানিকটা গুলিয়েই যাচ্ছে দমদমবাসীর। তবে ছোট বড় প্রচার সভায় মাইক হাতে সিপিআই(এম) প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী বলছেন, নির্বাচনী বন্ডের সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে বিজেপি, আর তারপরেই তৃণমূল। বাজারে গিয়ে আপনাকে যে বেশি টাকা দিয়ে ওষুধ কিনতে হচ্ছে, মাসে মাসে বিদ্যুতের মাশুল বেশি দিতে হচ্ছে, তার কারণ বুঝে নিতে ভুল করবেন না। নির্বাচনী বন্ডের নামে বড় মাপের তোলাবাজির ফল ভুগতে হচ্ছে আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষকে।
কামারহাটি, খড়দহ, বরানগর, বিটি রোডের দুপাশের বসবাসকারীরা বলছেন, এই তোলাবাজি পাড়াস্তরেও আমরা চিনে গেছি। বেআইনি নির্মাণ থেকে শুরু করে দোকান ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজির অবসান চাইছেন তাঁরা। মঙ্গলবার সাতসকালে বরানগরের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে, বেলঘড়িয়ায় কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে প্রচার সারছিলেন সুজন চক্রবর্তী এবং বরানগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিআই(এম) প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য। সরাসরি মানুষকে সাহস জোগাতে জোগাতে তাঁরা বলেছেন, ভরসা রাখুন, এবার বদল হবেই। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, ব্যালকনি কিংবা জানলা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মানুষও জানিয়ে দিয়েছেন, লাল ঝান্ডাতেই ভরসা রেখেছেন তাঁরা। মানুষের এই ভরসায় তৃণমূলও বদলের আশঙ্কা দেখতে পেয়েছে। তাই সোমবার রাতেই খড়দহে সিপিআই(এম)’র প্রচারে হামলা চালিয়েছিল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। এখন পরিস্থিতি এমনই যে রুখে দাঁড়িয়েছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা, পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় মানুষ।
কিন্তু সৌগত রায়ের পাশে তৃণমূলের সেই আগের ভিড় কই! নেই। কারণটা প্রকাশ্যে তৃণমূলের কোনও নেতাই বলতে চাইছেন না। কামারহাটি, খড়দহ আর পানিহাটির তিন বিধায়ক, মদন মিত্র, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় আর নির্মল ঘোষ এখন তৃণমূল সামলানোর চাইতেও গোষ্ঠী সামলাতে বেশি ব্যস্ত। ফলে সৌগত রায়ের রুদ্ধ পথ আর খোলার সম্ভাবনা নেই।
Comments :0