সিএজি’র দু’বছরের পুরানো একটি রিপোর্ট নিয়ে সরগরম হয়েছে রাজ্য। সেই রিপোর্টেই সিএজি দেখিয়েছিল কন্যা শ্রী, রূপশ্রীর থেকে অনেক বেশি টাকা এনজিও-দের দিয়েছে মমতা-সরকার। যার জবাব আজ পর্যন্ত মেলেনি। ২০১৬-র বিধানসভার বছর থেকে ২০২১-র বিধানসভা— এই পাঁচ বছরে ১ লক্ষ কোটির বেশি টাকা মমতা ব্যানার্জির সরকার এনজিও-দের দিয়েছিল বলে সিএজি জানায়।
ওই সময়েই রাজ্যে আরএসএস, সঙ্ঘর তৎপরতা বেড়েছিল। আর সরকার থেকে পাঁচ বছরে ১ লক্ষ কোটির বেশি সাহায্য পাওয়া সেই এনজিও-গুলির একটি বড় অংশ আরএসএস, সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত বলেই আশঙ্কা অনেকেরই। তাঁদের একাংশ রাজ্যের অর্থ দপ্তরের আধিকারিকরা।
যে রিপোর্টটি হঠাৎ এখন হই চই বাঁধানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা মূলত ভোটের আগে বিজেপি এবং মমতা ব্যানার্জিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। ধার করেও মমতা ব্যানার্জি কন্যা শ্রী, রূপশ্রীতে টাকা দেন, এটি বলার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ২০২০-২১ আর্থিক বছরে রাজ্যের ওই অডিট রিপোর্ট কম্প্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল(সিএজি) প্রকাশ করেছিল ২০২২-র জানুয়ারিতে। সিএজি’র ঘরে পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত ৬টি রিপোর্ট পড়ে আছে। যা প্রকাশের নামগন্ধ দেখা যাচ্ছে না। ২০২৩-এ পশ্চিমবঙ্গের কোনও অডিট রিপোর্ট সিএজি প্রকাশ করেনি। ওই রিপোর্টগুলিতে মমতা-শাসনের অনেক কাণ্ড প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সিএজি চুপ।
পুরানো রিপোর্টির সব কথাও সামনে আসছে না। তারই একটি এনজিও সংক্রান্ত। কী লিখেছিল সিএজি?
রাজ্যের তৃণমূল সরকার দেদার টাকা দিয়েছিল এনজিও-দের। অর্থাৎ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। সেই আর্থিক সহায়তা সম্পর্কে তাদের রিপোর্টে সিএজি লিখেছিল,‘‘২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে পশ্চিমবঙ্গের সরকার তার আয়ের প্রায় ২৬.২৪% বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বাবদ দিয়েছে, যাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নজরদারির কোনও যথার্থ ব্যবস্থাপনাই নেই। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।’’ আর কী? সিএজি’র বক্তব্য,‘‘তাছাড়া ওই ২৬.২৪% টাকার ৮০.৯০% গেছে এনজিও এবং অন্যান্যদের কাছে। যারা আদৌ সরকারের কাছে দায়বদ্ধই নয়। যারা অডিটের আওতাতেই আসে না।’’
অর্থাৎ যারা কোথায় টাকা খরচ করল, কেন করল— তা সরকারকে জানাতে তারা বাধ্য নয়। তাদের হিসাবও সরকার দেখতে পারে না। সরকারের টাকা খরচের হিসাবে সেই খরচ দেখানোও হয় না। গত বিধানসভা নির্বাচনের বছরে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা(এনজিও)-কে দেওয়া হয়েছে ২৭,০৪৮ কোটি টাকা। এই এনজিওগুলির বড় অংশই তৃণমূলের নেতা, নেত্রীদের নামে, বেনামে পরিচালিত বলেই আশঙ্কা। এরা মূলত নানাভাবে মানুষকে তৃণমূলের পক্ষে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া সরকার তার হিসাবে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ‘অন্যান্য’ হিসাবে বর্ণিত একটি খাতে। যেখানে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে রাজ্য সরকার ১০,৮৫৯ কোটি টাকা দিয়েছে।
কখন? ২০২০-২১০-এ। ঠিক বিধানসভা নির্বাচনের বছরে। সেই এনজিও-দের তালিকায় কী আরএসএস, সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত সংগঠন আছে? থাকার আশঙ্কা প্রবল। সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জি সরকারের এই বিষয়ে মৌনতা। সিএজি-ও স্বীকার করেছে এই সংগঠনগুলি ‘অডিটের আওতাতেই আসে না।’
সিএজি দেখিয়েছিল, পাঁচ বছরে এনজিও-গুলিকে দেওয়া হয়েছিল ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগের আর্থিক বছরে তা সর্বোচ্চ— ২৭ হাজার কোটির বেশি! কোন বছর কত টাকা? ২০১৬-১৭-তে দেওয়া হয়েছিল ১৫,৯৪১ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮-তে ওই সহায়তার পরিমাণ ছিল ২১,১২৩ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯-এ রাজ্য এনজিও-দের দিয়েছে ১৯,৪৬১কোটি টাকা। ২০১৯-২০-তে এই ক্ষেত্রে বেলানো হয়েছে ২৩,২৪৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১-এ দেওয়া হয়েছিল ২৭,০৪৮ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে ২০১৬-র বিধানসভার বছর থেকে ২০২১-র বিধানসভার বছর পর্যন্ত রাজ্যের কোষাগার থেকে এনজিও-দের মমতা ব্যানার্জির সরকার দিয়েছে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।
ওই একই সময়ে রাজ্যের পৌরসভাগুলিকে রাজ্য সরকার দিয়েছে অনেক কম— ২৩,০৯৩ কোটি টাকা। আর পঞ্চায়েতগুলিকে? দেদার লুটের পঞ্চায়েতকে রাজ্য দিয়েছে ওই পাঁচ বছরে মাত্র ৬৫,৯৫৬ কোটি টাকা মাত্র। যা এনজিও-দের দেওয়া টাকার অর্ধেকের কাছাকাছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সহায়তা পেয়েছে মাত্র ২০,২৪৮ কোটি টাকা।
রাজ্য সরকারের আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে টাকা দেওয়ার পরিমাণ লাগাতার কমিয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকার। সিএজি তাও উল্লেখ করেছিল রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে ওই পাঁচ বছরে রাজ্যের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি যথাক্রমে ৪৮৭২, ১৮৯৩, ১১১৭, ২৯৮ এবং ১৭৯ কোটি টাকা পেয়েছে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে।
এই সবের তুলনায় কন্যা শ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পে খুবই সামান্য টাকা খরচ করেছিল রাজ্য সরকার।
সিএজি সেই রিপোর্টে আরও জানিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার ২০২০-২১-র বাজেট পেশের সময় ঘোষণা করেছিল ‘বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা’ প্রকল্প। চিকিৎসা, প্রভিডেন্ড ফান্ডের মতো কিছু সুযোগ সুবিধা শ্রমিকদের পাওয়ার কথা এই প্রকল্পে। মূলত অসংগঠিত শ্রমজীবীদের সুরক্ষার প্রকল্প এটি। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে এই প্রকল্প চালু হয়। তখন শ্রমিকদের অল্প কিছু টাকা দিতে হতো। সরকার দিত একটি অংশ। তৃণমূল ঘোষণা করে কোনও টাকাই শ্রমিকদের দিতে হবে না। সিএজি বাজেট পর্যালোচনা করে জানাচ্ছে, ২০২০-২১-এ এই খাতে সরকার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। তার ঘোষণাও হয়েছিল। সরকার দিয়েছে কত? ১৯২ কোটি টাকা। যা মোট বাজেট বরাদ্দের ৩৮%। অথচ এই সময়কালে মেলা, উৎসবে দেদার টাকা উড়িয়েছে সরকার।
আর একটি প্রকল্প ‘চা সুন্দরী।’ এই প্রকল্পে চা বাগানের শ্রমিকদের পাকা বাড়ি তৈরি হবে বলে মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছিলেন। বরাদ্দ ঘোষিত হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। সরকার দিয়েছে ৪৩ লক্ষ টাকা — ০.০১%।
আর একটি প্রকল্প ‘কর্মসাথী প্রকল্প।’ এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হিসাবে মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছিলেন যে, কর্মহীন যুবক যুবতীদের ঋণ, ভরতুকি দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে তাঁরা স্বনির্ভর হতে পারবেন। বাজেটে ঘোষিত হয়েছিল— বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা। সরকার দিয়েছিল ২২লক্ষ টাকা— ০.০৪%।
‘বঙ্গশ্রী’ এমন আর একটি প্রকল্প। ক্ষুদ্র, ছোট, কুটির শিল্পকে সাহায্যের জন্য এই প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বাজেটে বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। মমতা ব্যানার্জির সরকার একটি টাকাও দেয়নি এই প্রকল্পে। যদিও ৭৭টি সহায়তার আবেদন সরকারের ঘরে জমা পড়েছিল।
Comments :0